অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে ছটপট করে মরছে মানুষ

687

মিরর বাংলাদেশ :  শ্বাস নিতে পারছে না রোগী। তীব্র যন্ত্রণায় কাতর। সাহায্যের আকুতি। চোখের সামনে ছটফট করছে। এ মুহূর্তে দরকার অক্সিজেনের। দু’চোখ খুঁজে ফেরে অক্সিজেন। কিন্তু নেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা। অক্সিজেনের জন্য মরণাপন্ন রোগীদের এমন কান্না হাসপাতালে হাসপাতালে।

কী সরকারি, কী বেসরকারি হাসপাতাল। অক্সিজেন সংকট সবখানে। অথচ রোগীকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন অক্সিজেনের। স্বজন, চিকিৎসক সবাই অসহায়। এক সময় চোখের সামনেই অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রোগী। দেশে করোনাকালে হাসপাতালগুলোর চিত্র এমনই। এমনিতেই করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই শ্বাসকষ্টে ভোগেন। করোনা আক্রান্ত এমন রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করতে গলদঘর্ম হতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক্ষেত্রে বেশ সজাগ। করোনা রোগীদের ভর্তি করাতে তাদের অনীহা। সরকারি হাসপাতালগুলোও কম নয়। কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা হলেও কেউ হাসপাতালে যেতে চান না। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেই। এমন রোগীকে নিয়ে স্বজনরা ছোটেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এক এক করে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি করানো সম্ভব হয় না। এমন অনেকেই অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছেন। আর যারা হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছেন তাদের অক্সিজেনের জন্য যুদ্ধে নামতে হয়। রোগী অনুযায়ী আইসিইউ সিট সংখ্যা কম। আবার অক্সিজেনের সিলিন্ডারও কম। কোথাও কোথাও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে ভর্তি করানো কঠিন। সিট নেই। এ অবস্থায় অক্সিজেনের জন্য কান্না দিন দিন ভারী হচ্ছে। লাশের সারি হচ্ছে দীর্ঘ।
অক্সিজেন জীবন বাঁচাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য এ এক মহা উপায়। যা মুমূর্ষু করোনা রোগীদের দেয়া হয়। হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হয় এ অক্সিজেন। অথচ বর্তমানে চরম সংকট এই বায়ুর। মূল্যবান জীবন বাঁচানোর এই কৃত্রিম বায়ু এখন স্বর্ণের চেয়েও দামি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এরকম চিত্র বর্ণনা করেছেন একজন চিকিৎসক। বলেছেন, সেখানে একশ’ জনেরও বেশি রোগী রয়েছে। বেশিরভাগ রোগীরই অক্সিজেন দরকার। তাও মিনিটে ১৫ লিটার করে। এর মধ্যে যারা ১৮টি পোর্টের কাছাকাছি বেডে ফ্লোরিং করছেন, তারা একটা পোর্ট থেকে চার পাঁচজন করে অক্সিজেন নিচ্ছেন। বাকি রোগীরা ছটফট করছেন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ফ্লোরেও হাঁটার মতো জায়গা নেই। রোগীরা রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছেন। এক বেড থেকে অন্য বেডে কোনো দূরত্ব নেই। অক্সিজেন সমস্যা এতটাই প্রকট যে তা দেখে চিকিৎসকরা রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন। একজন চিকিৎসকের ভাষায় মরুভূমিতে আপনার এক বুক পিপাসা, আর সে সময় আপনাকে বলা হচ্ছে আপনি থুথু গিলে পিপাসা নিবারণ করেন। অন্য আরেক চিকিৎসক বলছেন, পুকুর থেকে মাছ তোলার পর মাছ যেরকম ছটফট করে। অক্সিজেনের জন্য রোগীরা ঠিক সেরকমই করছেন। তিনি বলেন, ২৫ জন রোগীর জন্য নির্ধারিত একটা জায়গা। এর মধ্যে ১৮/২০টা বেডে অক্সিজেনের পোর্ট রয়েছে। একটা পোর্ট একজনমাত্র রোগীর অক্সিজেন জোগান দিতে পারে। সেখানে একশ’ জনেরও বেশি রোগী। বেশিরভাগ রোগীরই অক্সিজেন দরকার। তাও মিনিটে ১৫ লিটার করে। এমন চিত্র রাজধানীসহ সর্বত্রই। শুধু অক্সিজেন নয়, আইসিইউ এবং সাধারণ শয্যার সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে হাসপাতালগুলোয়। করোনা রোগীরা হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না। দেশে প্রতিদিনই করোনাা রোগী বাড়ছে হু হু করে। সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও লম্বা হচ্ছে। অনেকে চিকিৎসা না পাওয়ার আগেই উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেছেন, প্রচুর টেস্ট করালে বর্তমানে যা শনাক্ত হচ্ছে, তার দশগুণ বেশি রোগী শনাক্ত হবে। যারা শনাক্ত হচ্ছেন না, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। তিনি র‌্যাপিড টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে করোনা টেস্টের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার চিত্র চোখে পড়েছে। কিন্তু করোনার সন্দেহভাজন অনেক রোগী পরীক্ষা করাতে পারছেন না। শত শত রোগী করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে পদে পদে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন হাসপাতাল ও বুথ সেন্টারে। পরীক্ষা করাতে তিন-চার দিনও অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। খুব ভোরে এসেও পারছেন না পরীক্ষা করাতে। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের একজন সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জানান, দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। কিট সংকট রয়েছে চরমে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা আনোয়ার আহমেদ। তার স্ত্রী করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন। শনাক্ত হওয়ার পরপর সম্প্রতি রাজধানীর করোনা বা কোভিড-১৯ হাসপাতলে ভর্তি হওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন তারা। কিন্তু কোথায় সিট না পেয়ে পরে ঝুঁকি নিয়েই বাসায় থাকেন। এখন কিছুটা সুস্থবোধ করছেন। শুধু অনোয়ার দম্পতি নয়, করোনার রোগীরা সরকারি হাসপাতালে সিট না পাওয়ার অহরহ অভিযোগ আসছে। একটি সিট পেতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালে করোনার রোগীরা সিটা পাচ্ছেন না। যদিও করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত যে হাসপাতালগুলো আছে সেই হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই অবস্থা।
ওদিকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এএসএম লুৎফুল কবির শিমুল নিয়মিত রোগী দেখেন চট্টগ্রামের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হন করোনায়। বাসায় অবস্থান করে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি কেবিনে ভর্তি হতে অনুনয় করে ফোন করেন এবং বলেন কোন ডাক্তার নার্সকে সেখানে যেতে হবে না। কিন্তু পরিচালক সরাসরি জানিয়ে দিলেন কোন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে তিনি হাসপাতাল ভর্তি দিবেন না। পরে বাসায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার চেয়েছিলেন ডা. শিমুল। কিন্তু দেননি।
ডা. শিমুল আক্ষেপ করে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন, করোনা মানুষ চিনিয়েছে, করোনার শিক্ষায় যদি বেঁচে থাকেন, গাছতলায় চেম্বার করবেন। তবুও ফেরত যাবেন না মুখোশধারি ম্যাক্স হাসপাতালের পরিচালকের কাছে।
চট্টগ্রামে নিজের হাসপাতালে একজন ডাক্তারও যখন নিজের চিকিৎসার জন্য আহাজারি করছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হাসপাতালে হাসপাতালে একটি বেড ও অক্সিজেনের জন্য রোগী নিয়ে আহাজারি করছেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু পাচ্ছেন না। হোক সে করোনা আক্রান্ত বা অন্য রোগী। আইসিইউ দুরে থাক হাসপাতালের একটি বেডই যেন সোনার হরিণ। চিকিৎসা না পেয়ে অসংখ্য ব্যক্তি মারা যাচ্ছে নিজের বাড়িতে। লবিং করে যে সব রোগী ভর্তি হচ্ছে, তারাও পরবর্তীতে লাশ হয়ে ফিরছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মঙ্গলবার একদিনে সারাদেশে মারা গেছে ৩৭ জন করোনা আক্রান্ত রোগী। সেখানে ১৫ জনই চট্টগ্রামের। অথচ আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে এতোদিন এগিয়ে ছিল ঢাকা। কিন্তু এই প্রথম ঢাকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, শয্যা ও অক্সিজেন সংকটে প্রাণহানী বেশি ঘটছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর কারন হচ্ছে করোনা আক্রান্তের তুলনায় চট্টগ্রাম শয্যা অনেক অনেক কম। সে হিসেবে নেই আইসিইউ ভেন্টেলেটর। যেটা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ বিষয়ে স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার বলে মত দেন তিনি।
করোনার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল। হাসপাতালটিতেও করোনার সিটের সংকট রয়েছে প্রকট। এই হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল চিকিৎসক বলেন, সবমিলে তাদের হাসপাতালে ২০৪টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ১৭০টি শয্যা। আইসিইউ রয়েছে ২৬টি। ডায়ালাইসিসের জন্য রয়েছে ৮টি সিট। কিন্তু রোগী আসছেন অনেক বেশি। অনেক রোগী আছেন যাদেরকে এখনই আইসিইউ দিতে হবে। কিন্তু দেয়া যাচ্ছে না। ফলে রোগীরা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আবার আমাদের ভর্তি রোগীদের অনেককেই আইসিইউ দিতে পারছি না। ফলে সংকটতো আছেই।

অপরদিকে করোনার জন্য বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ বলেন, রোগীর চাপ অনেক। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে ২৫০ বেড করোনার রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৩৫১ রোগী ভর্তি ছিল। গত ২ সপ্তাহ থেকেই আইসিইউ বেড খালি হচ্ছে না। আইসিইউতে ১০টি সিট রয়েছে। আরো ১৭টির কাজ চলছে। ছাড় না পাওয়ায় নতুন করে আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশে প্রতিদিন যেভাবে রোগী বাড়ছে সেভাবে ভর্তি রোগী ছাড় হচ্ছে না। তাই বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, এই রোগীর জন্য অক্সিজেন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অক্সিজেনের প্রচুর সংকট রয়েছে। তার হাসপাতালে ৪৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে তিনি উল্লেখ করেন। করোনা বিশেষায়িত রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতাল আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা ইউনিটে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ। একজন ছাড় পেলে অপেক্ষারত থেকে অন্য একজনকে ভর্তি করা হচ্ছে। ডা. এহতেশামুল হক বলেন, সাধারণ ওয়ার্ডে এতদিন রোগী কিছুটা কম ছিল। কিন্তু কয়েকদিন থেকে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-চীন যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা আক্রান্ত পাঁচ শতাংশ রোগীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয় এবং আরো ১৫ শতাংশের জন্য প্রয়োজন হয় ঘনীভূত অক্সিজেন। যার অর্থ ২০ শতাংশ রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন হয়। অথচ দেশে রোগীর তুলনায় ২০ শতাংশের ধারে কাছেও নেই আইসিইও ব্যবস্থা। গত সোমবার দেয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হিসাবে জানা যায়, করোনা রোগীদের জন্য সারা দেশে মাত্র ৩৯৯টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ২১৮টি, ঢাকা বিভাগে ৪৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি, বরিশালে ১৮টি, সিলেট ১৬টি, রাজশাহী ২৮টি, খুলনা ১৮টি, রংপুর ১৩টি। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৮টি জেলায় কোনো ধরনের আইসিইউ নেই। আর যে পরিমাণ আইসিইউ রয়েছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে তা মোটেও রোগীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ করছে সংশ্লিষ্টরা। শুধু এ কারণে করোনা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই মারা যাচ্ছেন আইসিইউ’র অভাবে। অক্সিজেন না পেয়ে। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে ৭৩৭টি আইসিইউ বেড রয়েছে। জানা যায়, দেশের প্রায় ৩৭টি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত। এগুলোতে করোনা রোগী ছাড়া আর কারও চিকিৎসার সুযোগ নেই। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় ৫০ হাজার শয্যার মধ্যে থেকে মাত্র ৭ হাজার শয্যাকে করোনা সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য আইসোলেশন শয্যা হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীত গতকাল পর্যন্ত ৫৫ হাজারের ওপরে করোনা রোগীই শনাক্ত হয়েছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও নার্সিং অধিদপ্তরের অধীনে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক জনবলসহ ১ লাখ ৯৩ হাজার, ৬৮৭টি পদ থাকার কথা। কিন্তু প্রায় এক-পঞ্চমাংশের অধিক পদে জনবল ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, কিন্তু বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ জন। কিন্তু এর মধ্য থেকে করোনা রোগীদের জন্য আবার চিকিৎসক ভাগ হয়ে গেছে। দেশের মোট হাসপাতাল শয্যার ৬৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালের। কিন্তু করোনা সংকটে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের উদাসীনতা ভয়ঙ্কর বলছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে সম্পূর্ণ কার্যকর আইসিইউ লাগবেই। আইসিইউয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেন্টিলেটর ফুসফুসের সমস্যায় ভোগা রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করে। এগুলো করোনা রোগীদের বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, করোনাভাইরাস শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে। অথচ দেশে ভেন্টিলেটরও নেই তেমন একটা। জানা গেছে, মাত্র ১৯০টি ভেন্টিলেটর করোনার চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করেছে। যার মধ্যে ঢাকাতে আছে ৭৯টি এবং বাকিগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে থেকে কয়েকবার ভেন্টিলেটর আনার ঘোষণা দিলেও এর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, কোনো দেশের হাসপাতালে রোগীর জন্য যত শয্যা থাকবে, সেগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হয়। এ অনুযায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর থাকার কথা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। তবে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটার পরিচালনা জন্য প্রশিক্ষত চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজন। সেটিও পর্যাপ্ত নেই দেশে। ২০০৮ সালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার কোর্স চালু হলেও এখন পর্যন্ত ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ওপর এমডি করেছেন মাত্র ৩০ জন চিকিৎসক, যেখানে প্রয়োজন কমপক্ষে ৬০০ জন। জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোর্সটি চালু রয়েছে। চিকিৎসকের পাশাপাশি নেই ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষিত কোনো নার্স নেই। দেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ওপর নার্সদের পড়া শোনার সুযোগ নেই। আইসিইউতে যেসব নার্স ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা দেন, তারা মূলত দেখে দেখে কাজ শিখেছেন। শুরুর দিকে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করা হলেও পরবর্তীতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ২১টি এবং ঢাকার বাইরে আরো ২১টিসহ মোট ৪২টি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অথচ এসব ল্যাবরেটরিতে যে পরিমাণ টেস্ট করানোর কথা সে পরিমাণ টেস্ট করানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। আবার যারা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যারা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ফলে তারা ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেক সময় টেস্টে রেজাল্ট দিতেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মিডিয়া সেলের ফোকাল পয়েন্ট মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, এই সংকট দীর্ঘদিনের। এই সংকট বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে ইতিমধ্যে আমরা কিছু চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি। আরো তিন হাজার টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে সরকার।
পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে আলেহার ঠাঁই হলো যেখানে: সম্প্রতি জ্বর আর মাথা ব্যথা নিয়ে রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে ঘুরেছেন কলাবাগানের আলেহা বেগম। কোনো হাসপালেই ভর্তি নেয়া হয়নি তাকে। প্রায় ৮ ঘণ্টা তাকে এম্বুলেন্সে থাকতে হয়। সবশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি। পরে টাইফয়েড ধরা পড়ে তার। এদিকে গত মাসে কিডনি রোগী একজন অতিরিক্ত সচিব ৯টি হাসপাতল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি। পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হলেও চিকিৎসার অভাবে মারা যান। এদিকে সামিরা ইসলাম নামে একজন চারদিন সিরিয়াল দিয়ে মোহাম্মদপুরের একটি বুথে করোনা টেস্ট করান। টেস্ট করানোর আবার চারদিন পর তাকে জানানো হয় তিনি করোনা পজিটিভ। সামিরা বলেন, এই ক’দিন আমি নিজ ইচ্ছায় আইসোলেশনে ছিলাম। হয়তো আমি সচেতন দেখে এটা করেছি বা নিজের যত্ন নিজে নিতে পেরেছি। কিন্তু বাকিদের কি হবে? ওরা কখন হাসপাতালে ভর্তি হবে। কখন চিকিৎসা নিবে। এর মধ্যে তো ওই ব্যক্তি দুনিয়া ছড়িয়ে দিবে। সাবিনা ইয়াসমিন নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী করোনা উপসর্গ নিয়ে গত রোববার কুয়েত বাংলাদেশ হাসপাতালে গেলেও তাকে সেখানে ভর্তি করানো হয়নি। হাসপাতাল থেকে তাকে বলে দেয়া হয়, এখানে শুধুমাত্র করোনা রোগীদের ভর্তি করানো হয়। এই প্রতিবেদক নিজেও পরিচয় গোপন করে গত সপ্তাহে হাসপাতালটিতে গেলে এমন ঘটনার প্রমাণ মিলে। রোগীর অবস্থা নিশ্চিত হওয়া ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না ওই হাসপাতালে। এমন ঘটনা দেশের প্রতিটি হাসপাতালের বর্তমান চিত্র। করোনা আক্রান্ত রোগী ও সাধারণ রোগী কেউই পাচ্ছে না সঠিক স্বাস্থ্যসেবা। প্রতিদিন হাজার তিনেক করোনা রোগী শনাক্ত হলেও এর বাস্তবিক হার অনেক বেশি বলে দাবি করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল। তিনি বলেন, প্রতিদিনই দেশে করোনাভাইরাসের আক্রান্তের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দেশের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হলেও এদের অধিকাংশই বুঝতে পারেননি যে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এ অবস্থাতে অনেক করোনা রোগী পাচ্ছেন না চিকিৎসা। হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে ভেন্টিলেশন ও আইসিইওর অভাবে মারা যাচ্ছেন করোনা রোগীরা। অক্সিজেনের অভাবে চরম কষ্ট ভোগ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন অনেকে।
নতুন যন্ত্রণা কোভিড সনদ: করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ আছে এমন রোগীদের জন্য এখন নতুন যন্ত্রণা হচ্ছে কোভিড ও নন-কোভিড সনদ। করোনার কোনো ধরনের উপসর্গ থাক আর না থাক নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া রোগী দেখছেন না চিকিৎসকরা। অন্যদিকে পজিটিভ রিপোর্ট ছাড়া করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলো ভর্তি করছে না। ফলে করোনা পরীক্ষা করানোর আগেই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে মারা যাচ্ছেন রোগীরা। করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে নানা জটিলতা, বিশৃঙ্খলা। কোথায় গেলে পরীক্ষা হবে অনেকেই জানেন না। আবার দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলা হচ্ছে আজ হবে না। আবার কেউ পরীক্ষার সুযোগ পেলেও রিপোর্ট পেতে লাগছে পাঁচ-ছয় দিন। ফলে রিপোর্ট আসার আগেই অনেককে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে বিনা চিকিৎসায়। এছাড়া গত মাসে সকল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দিলেও কেউ মানছেন না এমন নির্দেশনা। এ বিষয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি এম এ মুবিন খান বলেন, আমি নির্দেশনাটি দেখেছি। কেউ কেউ ইতিমধ্যে চিকিৎসা দিতে শুরু করেছে। তবে যেসব হাসপাতালে পৃথক দু’টি ভবন আছে তাদের জন্য এটা সহজ হবে। না হয় একই ভবনে করোনা চিকিৎসা দেয়া ঝামেলা হয়ে যাবে। তবে সাধারণ রোগী ভর্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সবাই সাধারণ রোগী ভর্তি করাচ্ছেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রের বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা না। এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতলের হট লাইনে ফোন দিয়ে করোনা উপসর্গ রোগী ভর্তি না করানোর তথ্য পেয়েছেন। এ বিষয়ে বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মিডিয়া সেলের ফোকাল পয়েন্ট মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। আসলে আমরা ব্যবস্থা নিবো। তবে সকল হাসপাতাল তো এক সঙ্গে সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টরগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যখাত অন্যতম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ বলেন, প্রতিটি রোগীকে কোথায় ও কীভাবে চিকিৎসা দেয়া হবে তা নিয়ে পরিকল্পনার দরকার ছিল। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অথবা বেশি সংক্রমিত এলাকায় একইসঙ্গে চিকিৎসা দেয়ার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয়া যেত। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল না ভেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত ছিল সকলকে এক সঙ্গে নিয়ে কাজ করার। সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণেই আজকে এই পরিস্থিতি হয়েছে। তাছাড়া সরকার এই খাতে যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করে সেটা খুবই নগন্য। প্রচুর পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকেই সরকার বলে আসছে যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে আমরা কিন্তু তা দেখতেই পাচ্ছি। চিকিৎসকদের রোগীদের কাছাকাছি যেতে হয়, তাদেরকে চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু চিকিসৎকরা যখন পিপিই সংকটে ভুগছিল এবং আক্রান্ত হতে শুরু করলো তখন থেকেই তারা আতঙ্কগ্রস্ত হতে শুরু করলো। সেই আতঙ্ক এখনো কাটেনি। তবে এই খাত যে পরিমাণ দলীয়করণ হয়, বা সিন্ডিকের বলয় আছে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ( বিএমএ)-এর সাবেক সভাপতি ও জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ড. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার প্রয়োজন। যা না হওয়ার কারণে আজ স্বাস্থ্য খাতের এই অবস্থা।

সুত্র : মানবজমিন