* ৭ খুনের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা
মিরর বাংলাদেশ : অহরহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘঠিত হওয়ায় অরক্ষিত হয়ে পড়ছে নৌপথ। সহজ এবং আথিক ব্যয় কম হওয়ায় মানুষ নদীপথে যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনে বেশি আগ্রহী কিন্ত সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনার কারনে নৌপথে দেখা দিয়েছে নুতন করে আতংক। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার ঈশানবালায় মেঘনা নদীতে মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের এমভি আল-বাখেরা নামে সারবাহী একটি জাহাজের সাতজনকে হত্যার ঘটনায় ফের নৌপথের সুরক্ষার বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে।
নিরাপত্তার দাবীতে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা। এর ফলে নৌপথে মালবাহী, তেল-গ্যাসবাহী, বালুবাহীসহ সব ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে
খোজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌপথে প্রায়ই ঘটছে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি। জাহাজ মালিক, সুকানি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, হাতিয়া, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, সিলেটের বেশ কিছু স্পটে জলপথে চাঁদা তোলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ডাকাতদের মারধরের শিকার হতে হয় অনেককে।
জানা গেছে, গত এক দশকে দেশে নতুন নৌযান নিবন্ধিত হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি। বর্তমানে যাত্রীবাহী ৮৫৭টি, যাত্রীবাহী বোট ৫৪৯টি, মালবাহী ৩ হাজার ৭৪৪টি, তেলবাহী ৩৯০টি এবং বালুবাহী ৬ হাজার ৩৭৯টি নৌযান রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ড্রেজার ১ হাজার ৭৯৬টি, পণ্যবাহী নৌযান ১ হাজার ২১২টি, বার্জ ৫৪৪টি, টাগবোট ১৭৯টি, স্পিডবোট ১ হাজার ৩টি, ফেরি ৪৬টি, ওয়ার্কবোট ১৩৭টি, পরিদর্শন বোট ২৬টি, ট্যুরিস্ট লঞ্চ ১০টি ও অন্য নৌযান ১০৮টি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশ কিছু এলাকার নৌপথ রীতিমতো আতঙ্কের। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নারায়ণগঞ্জের বন্দও কলাগাছিয়া, ধলেশ্বরীর মোহনা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, চাঁদপুরের হাইমচর, দশআনী, মাঝেরচর,পদ্মা নদীর শিবচর ও মাওয়া এলাকার একাধিক পয়েন্ট, মেঘনা ব্রিজের নিচ থেকে সিলেট যেতে ৪-৫টি জায়গা, হাতিয়া, ইলিশা ও ভৈরব। এ ছাড়া মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলার পাশ দিয়ে মেঘনা নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার বয়ে গেছে। মোংলা বন্দর থেকে চট্টগ্রামমুখী জাহাজ এই র”টে যাতায়াত করে। পণ্যবাহী যানবাহন প্রায়ই মেহেন্দীগঞ্জের ভাবনির চর ও উলানিয়ার মল্লিকপুর অতিক্রম করার সময় ডাকাতের কবলে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, সিলেট থেকে বাল্কহেডে মালপত্র নিয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত আসতে সাধারণত তিন দিন লাগে। নিয়ম অনুযায়ী, বাল্কহেড ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত চলাচল করে। আর অন্য নৌযান জোয়ার-ভাটা মেনে পাড়ি দেয়। একটি মালবাহী জলযানকে সিলেট থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত আসতে নানা জায়গায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বড় ধরনের বিপদ এড়াতে অধিকাংশ সময় ৮-১০টি জাহাজ বহরে চলাচল করে থাকে। তখন এসব জাহাজে গণচাঁদা তোলা হয়। আবার আলাদাভাবে কোনো জাহাজ চলাচলের সময় চাঁদাবাজি ও ডাকাত চক্রের কবলে পড়ে। চট্টগ্রাম থেকে তেল, আটা, ময়দা, রড, সিমেন্টসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে শত শত জাহাজ প্রতিদিন নৌরুটে দেশের গন্তব্যে ছেড়ে যায়।
ডাকাতদের ভয়ে ভৈরব থেকে কোনো রকম মালপত্র লোড ও যাত্রী বহন করছিল না ট্রলার। নদীবন্দর ভৈরব থেকে সরাইলের অর”য়াইল ২২ কিলোমিটার এলাকা। সাধারণত এ রুটে ৫-৭টি নৌঘাটে মাল লোড-আনলোড হয়। এর মধ্যে রয়েছে– ভৈরব, আশুগঞ্জ, আজিমপুর, বড়ইচড়া, পরমানন্দপুর, বৈশ্বর ও অর”য়াইল নৌঘাট। এই র”টে ট্রলার আশুগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট থেকে পানিশ্বর এলাকার মা-মণি ইটখলা পর্যন্ত তিন কিলোমিটারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় ডাকাতি সংঘটিত হয়। সরাইলের পানিশ্বর এলাকা হচ্ছে মেঘনা ও কুশিয়ারা নদীর মিলনস্থল। এ পানিশ্বর এলাকায় ত্রিমুখী নদীপথ থাকায় ডাকাতরা ডাকাতি করে সহজে পালিয়ে যেতে পারে। এদিকে দুই থানার রশি টানাটানিতে ডাকাতরা সুযোগ নিচ্ছে। গত তিন মাসে ৫টির মতো ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর দুটি নৌকায় ডাকাতি হয়েছে। ১১ ও ১২ অক্টোবর ডাকাতরা ধাওয়া দেয় কয়েকটি নৌযানকে।
এ ছাড়া গত শনিবার কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদে রৌমারী-চিলমারী নৌপথে ইজতেমার উদ্দেশে যাওয়া একটি যাত্রীবাহী নৌকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতরা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা ও বিভিন্ন মালপত্র লুট করে। দুটি ডিঙি নৌকায় করে ১৬-১৭ জনের একটি ডাকাত দল এসে যাত্রীবাহী নৌকার গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়।
নৌকার মাঝি ও ভুক্তভোগী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলা সেতুর পূর্বপাড়ে ফজলুল করীম জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় তিন দিনব্যাপী ইজতেমার কার্যক্রম শুর” হয়েছে। এতে অংশ নিতে সকালে রৌমারী থেকে চরমোনাই অনুসারীরা নৌকায় করে রওনা দেন। নৌকায় ১৮ জন যাত্রী ছিলেন।
নৌকাটি চিলমারী উপজেলায় নদীর মাঝপথে পৌঁছলে দুটি ডিঙি নৌকায় করে ১৬-১৭ জনের ডাকাত দল নৌকাটি ঘিরে ফেলে। এর পর পিস্তল ও দেশি অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে প্রত্যেকের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। নৌকার একটি শ্যালো ইঞ্জিন ভাঙচুর করে হ্যান্ডেল নদীতে নিক্ষেপ করে।
লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হার”ন অর রশিদ বলেন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও হামলার ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে গেলে নৌপথের সীমানা নিয়ে ঠেলাঠালি করে পুলিশ। এ কারণে অধিকাংশ ঘটনায় মামলা বা জিডি করা যায় না। আবার শর্ষের মধ্যেও ভূত আছে। জাহাজের স্টাফদের মারধর করে টাকা-পয়সা, তেল ও মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এখন প্রাণে মেরে ফেলা হচ্ছে। সোমালিয়ার দস্যুরাও তো কোনো জাহাজের নাবিকদের হত্যা করে না।
নৌ-পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান সাংবাদিকদের বলেন, নৌ-পুলিশকে টহল জোরদারের নির্দেশ দিয়েছি। আমাদের জলযান ও জনবলের ঘাটতি আছে। জনবল না থাকায় আমরা ১৯টি ফাঁড়ি চালু করতে পারছি না। যেহেতু নৌ-পুলিশ তুলনামূলক নতুন ইউনিট, তাই সীমানা নিয়ে জটিলতা হয়। ধীরে ধীরে এটা কেটে যাবে। সব জলযানে সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চাঁদপুরে জাহাজে সাত খুনের রহস্য উদঘাটন এবং জড়িতদের বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন দাবিতে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা। এর ফলে নৌপথে মালবাহী, তেল-গ্যাসবাহী, বালুবাহীসহ সব ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ফেডারেশন সভাপতি মো. শাহ আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার কর্মবিরতি চলবে। এদিকে এই কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বেসিক ইউনিয়ন ও শাখার নেতারাসহ সব নৌযান শ্রমিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে ফেডারেশন। তবে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগের বিষয় বিবেচনা করে আপাতত সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে
শাহ আলম বলেন, আমরা আমাদের সারাদেশে ১০ হাজার ছোটবড় পণ্যবাহী নৌযান ও লক্ষাধিক শ্রমিকের নিরাপত্তা দাবি করছি। যারা ওই জাহাজে হতাহতের শিকার হয়েছেন সরকারের পক্ষ থেকে জনপ্রতি ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণও দাবি করছি। তিনি আরও বলেন, আকাশ মন্ডল এমভি আল বাখেরা জাহাজের আট স্টাফকে ঠান্ডা মাথায় যেভাবে কুপিয়েছেন এবং বিশাল একটি জাহাজ একাই চালিয়েছেন, এটা আদৌ সম্ভব না। এটা তার একার কাজ হতে পারে না। আকাশ মন্ডলের মাত্র এক মাসের বেতন বকেয়া ছিল। সামান্য বকেয়ার জন্য এই ঘটনা বোধগম্য নয়। আমরা এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন এবং এর সঙ্গে অন্য কারা ছিল তার সঠিক তদন্ত দাবি করছি।