মিরর বাংলাদেশ : রোববার, সকাল সাড়ে ৭টা। কাকরাইল হয়ে রমনা পার্কের রাস্তা ধরে এগুতেই হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের আগেই ফুটপাতে মানুষের লাইন চোখে পড়লো। সবাই মুখে মাস্ক পড়া, নারী ও পুরুষ উভয়ই। কেউ বসে, কেউ দাড়িয়ে। কেউ বা আবার পত্রিকা বা কোনো কিছু বিছিয়ে ফুটপাতেই শুয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করতেই তারা জানালেন করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য লাইনে আছেন তারা। এই লাইন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল পেরিয়ে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতার ভবনের নিচে গিয়ে ঠেকেছে।
ইন্টার কন্টিনেন্টালের উত্তর পাশের ফুটপাতে কথা হয় সাবিত হোসাইন নামের চশ্লিশোধর্ব এক ব্যক্তির সাথে। শত শত মানুষের মাঝে তিনিও স্ত্রীসহ রয়েছেন ফুটপাতে। একটি সুপার শপের ইনচার্জ তিনি। তার স্ত্রী সানজাদা আক্তার বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন। বাসা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। ভোর ৪টার দিকে সিরিয়ালে দাড়িয়েছেন। তারা জানান, গত ৫ মে করোনা টেস্টের পর করোনা পজিটিভ আসে সাবিত হোসাইনের। এরপর স্ত্রীকেও পরীক্ষা করানোর পর তারও করোনা পজিটিভ আসে। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তারা। এখন মোটামুটি সুস্থ্য বোধ করছেন। কিন্তু, করোনা পজিটিভই রয়েছে নাকি নেগেটিভ তা পরীক্ষার জন্য ৩ দিন হলো ঘুরেও পরীক্ষা করাতে পারেননি। তাই ভোররাতে সিরিয়াল দিয়েছেন তারা।
নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী মৈত্রীর স্টাফ সানজাদা আক্তার জানান, করোনা পরীক্ষার জন্য ৩ দিন রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ঘুরেছি। কিন্তু, সেখানে সুযোগ পায়নি পরীক্ষার। তিনি বলেন, মুগদাতে তিন দিন গেছি। লোক নাই, বোতল বা ইট বসিয়ে রেখে সিরিয়াল সাজিয়ে রাখতে দেখেছি। আমরা সেখানে পরীক্ষা করাতে পারিনি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে সানজাদা আক্তার বলেন, আমার করোনা পজিটিভ যখন ধরা পরে তখনো শারীরিক অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না। কিন্তু, করোনা দূর হলো কিনা তা পরীক্ষার জন্য যে ভোগান্তি হচ্ছে এটা তার চাইতেও খারাপ অবস্থায় নিয়ে এসেছে আমাকে। এতো ভোগান্তি হচ্ছে যে, আমি যদি চাকরি না করতাম, অফিসে কাগজপত্র না দিতে হতো তাহলে জীবনেও এই টেস্ট করতে আসতাম না। অফিসকে নেগেটিভ কাগজ দেখাতে হবে, তাই ঘুরছি।
কীভাবে হলো তাদের করোনা, জানতে চাইলে তিনি পাশে থাকা তার স্বামী সাবিত হোসাইনকে দেখিয়ে বলেন, ওর থেকেই হয়েছে। শপিংশপে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ওর করোনা সিন্ট্রম দেখা দেয়। জ্বর, মাথা ব্যাথা শুরু হয়। টেস্ট করার পর পজিটিভ আসলো। এরপর আমার টেস্ট করালাম, সেটাও পজিটিভ আসে।
হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের উত্তর পশ্চিম কোণে কথা হয় নয়ন উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির সাথে। তিনি পত্রিকা বিছিয়ে ফুটপাতে শুয়ে ছিলেন। কথা বলে জানা গেল তার বাড়ি নাটোর জেলায়। রাজধানীর ইস্কাটনে থাকেন। চাকরি করেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। তারও করোনা পজিটিভ। করোনা পজিটিভ আসার পর চিকিৎসা শেষে ফের পরীক্ষা করতে এসেছেন নেগেটিভ হয়েছে কিনা। রাত ২টা থেকে আছেন ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে। তার সামনে আরো অসংখ্য মানুষ। তিনি বলেন, এর আগেও ২ দিন এসেছি, সিরিয়াল পায়নি। তাই মধ্যরাত থেকে সিরিয়াল দিয়েছি।
জানা যায়, রাজধানীতে যে কয়েকটি জায়গায় করোনা টেস্ট করা হয়, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই (বিএসএমএমইউ) সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড় থাকে। রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এই লাইন শাহবাগে অবস্থিত বিএসএমএমইউ হতে ফুটপাত ধরে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল পেরিয়ে মন্ত্রিপাড়ায় গিয়ে ঠেকানোর দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার লম্বা এই সিরিয়ালে শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধকেও চোখে পড়ে। মুখে মাস্ক থাকলেও সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি তাদের। কোথাও কোথাও গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে বা শুয়ে থাকতে দেখা যায় মানুষকে। একদিকে যেমন, করোনা পজিটিভরা নতুন করে পরীক্ষা করতে এসেছেন নেগেটিভ হয়েছে কিনা, অন্যদিকে উপস্বর্গ নিয়ে পরীক্ষার জন্য এসেছেন অনেকে। কিন্তু সেখানে করোনা পজিটিভ থাকা ও উপস্বর্গ নিয়ে আসা সবাই যেন একাকার হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনে আড়াইশ থেকে তিনশ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। কিন্তু, প্রতিদিন সেখানে পরীক্ষার জন্য যাচ্ছেন কয়েকগুণ মানুষ। ফলে দীর্ঘ অপেক্ষা করেও দিন শেষে করোনা টেস্ট করাতে না পেরেয়ে বেশির ভাগকেই ফেরত যেতে হচ্ছে। পরের দিন মধ্যরাত বা ভোরবেলা থেকে তারা ফের লাইনে দাড়াচ্ছেন। করোনা টেস্ট করাতে আসাদের চোখে মুখে তাই হতাশা ও ক্ষোভ। সিরিয়ালে না দাড়িয়ে অনেককে অনিয়ম করে আগেই টেস্ট করানোর অভিযোগ পুরনো। সব মিলিয়ে চরম দূর্ভোগ করোনা টেস্ট করাতে আসা মানুষজনের। ভোগান্তি দূরে করে প্রতিদিন আরো বেশি সংখ্যক মানুষের করোনা টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ ভুক্তভোগীদের।
এদিকে, রোববার থেকেই রাজধানীর শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) পরিচালিত ফিভার ক্লিনিক এবং কোভিড-১৯ ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস সন্দেহে নমুনা পরীক্ষা করতে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পদ্ধতির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
বিএসএমএমইউ ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সেবার মান রক্ষা করা, রোগীদের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার ফলে সৃষ্ট ভোগান্তি কমানো এবং ভিড়ের কারণে রোগের সংক্রমণের বিস্তার রোধে অনলাইন পদ্ধতিতে অ্যাপয়েন্টমেন্টের এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছে, যেসব রোগীরা আজ (রোববার) অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন বা নেবেন তারা সোমবার (আজ) ফিভার ক্লিনিকে চিকিৎসকের পরামর্শসেবা নিতে পারবেন এবং করোনাভাইরাস ল্যাবরেটরির সেবাও নিতে পারবেন।
রোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফরমটি পাবেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রোগীরা অনলাইনে তাদের নাম, ঠিকানা, লিঙ্গ, বয়স ও মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট মোবাইল ফোন থেকে এসএমএসের মাধ্যমে সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট জানিয়ে দেয়া হবে এবং উল্লেখকৃত সময় অনুযায়ী ফিভার ক্লিনিকে এসে প্রেরিত এসএমএসটি প্রদর্শনপূর্বক চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। ল্যাবরেটরি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও এ