খাদিজা পারভীন উপমা : করেনার তথ্য গোপন রেখে চিকিৎসা নেয়ায় একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালের বিভাগ। শুধু বিদেশ ফেরা নয়, করোনা আক্রান্তের খবর পর্যন্ত গোপন করে প্রতিদিন অসংখ্য চিকিৎসককে আক্রান্ত করছেন । সবশেষ রাজধানীর মিডফোর্ড হাসপাতালের ৪৪জন ডাক্তার নার্স করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীদের বাস্তবতা বোঝানোর পাশাপাশি সেবা দানে চিকিৎসকদের আরও সতর্ক করা না গেলে কোভিড মোকাবিলায় চরম বিপদের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সব হাসপাতালে পিপিই সরবরাহের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য শিগগিরই আলাদা কর্ণার খোলার দাবি চিকিৎসকদের।
সারাদেশে আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসকদের ৯০ শতাংশই সাধারণ হাসপাতালের। এসব হাসপাতালে আগের নিয়মে সেবা অব্যাহত থাকায় আক্রান্তের হার বাড়ছেই। ডেল্টা, আনোয়ার খান মডার্ন, ইনসাফ বারাকা হাসপাতালের মতো সাময়িক সেবা বন্ধের তালিকায় প্রতিনিয়তই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম।
সম্প্রতি ইব্রাহিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত একজন রোগী তথ্যগোপন করে চিকিৎসা নিতে আসেন। মুমূর্ষু অবস্থায় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া রোগীর পরীক্ষা করতে চাইলে পরিবার তার কোভিড উনিশে আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেন। এরপরই বন্ধ করে দেয়া হয় সিসিইউ, কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয় ২০ জন চিকিৎসককে।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জন ডা. সাকলায়েন রাসেল জানান, স্বাভাবিকভাবে তারা মনের করছেন তারা লাভবান হচ্ছেন কিন্তু তা হচ্ছেন না। এক তারা পর্যায়ে শনাক্ত হচ্ছেন। এতে বিপদে পড়ছেন চিকিৎসক এবং হাসপাতাল।
অন্যদিকে তথ্য গোপনসহ না জেনে চিকিৎসা নিতে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫টি বিভাগের বেশ কয়েকটি ইউনিটের সেবা বিঘ্নিত হয়। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকা প্রায় অর্ধশতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করার কথা জানান ডিএমসি কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ জানান, শ্বাস কষ্ট হচ্ছে সেটা না বলে রোগীরা বলছেন পেটে ব্যথা হচ্ছে। এই রোগীদের শ্বাস কষ্ট হচ্ছে এবং এদের বাঁচানো যাচ্ছে না। এই অবস্থা যদি এখানে হয় তাহলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালগুলোতে আরও ভয়ানক অবস্থা।
তথ্য গোপনের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে সরকারকে সবার সেবা নিশ্চিত করার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রিদউয়ানউর রহমান জানান, রোগীদের অনুরোধ করব আপনারা সঠিক তথ্য চিকিৎসকদের দিন। না দিলে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল বিপদে পড়বে।
রোগীদের তথ্যগোপন ও অসচেতনতায় কোভিড যুদ্ধে ক্রমাগতভাবে রসদ কমছে বাংলাদেশের। সামাজিক সংক্রমণের চতুর্থ ধাপে তাই যে কোনো রোগীকে সেবা দানের পূর্বে পিপিই পরার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।
সুত্র জানায়, দেশে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের (পিপিই) সংকটের মধ্যেই এখন পর্যন্ত তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। তবে বিপত্তি ঘটছে লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের নিয়ে। অনেকে তথ্য গোপন করে হাসপাতালে যাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। আর সরকারি হাসপাতালগুলো চালু থাকলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। ফলে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম।
কভিড-১৯ উপসর্গ গোপন করে গত বুধবার রাজধানীর শ্যামলীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে চিকিৎসা নিতে আসেন এক বৃদ্ধ। দুদিন চিকিৎসার পর পরীক্ষায় তার শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্তত ১৩ স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে, যার মধ্যে একজন এরই মধ্যে জ্বরাক্রান্ত।
বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এ রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু পরীক্ষার অপ্রতুলতার কারণেও আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হওয়ায় চিকিৎসাসেবা নিতে বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ। ফলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্যদেরও সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করছেন এসব রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই চিকিৎসকদের সেবা দিতে হচ্ছে। রয়েছে পিপিইর সংকট। একই পিপিই একাধিক চিকিৎসককে ব্যবহার করতে হচ্ছে। সরবরাহ করা হয়নি এন৯৫ বা সমমানের কোনো মাস্ক। অথচ বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসকরাও ব্যাপক হারে সংক্রমিত হচ্ছেন নভেল করোনাভাইরাসে।
দেশে এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যসেবাসংশ্লিষ্ট কতজন এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়ের কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) নামে চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে গতকাল পর্যন্ত ১০২ জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত বুধবার। আবার একজন চিকিৎসকের সুস্থ হয়ে ওঠারও খবর মিলেছে।
চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির হিসাবে, এরই মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ৫৭ জন নার্সের শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। কোয়ারেন্টিনে আছেন আরো প্রায় ২৭০ জন নার্স। আর গত শুক্রবার পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এমন হাসপাতালের সংখ্যা সারা দেশে ২৪টি। এর মধ্যে সারা দেশে ১৪টি সরকারি হাসপাতাল ও রাজধানী ঢাকার ১০টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হসপিটাল (এ্যাপোলো হসপিটাল), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ধানমন্ডির ইবনে সিনা হসপিটাল, আজগর আলী হসপিটাল, মিরপুরের ডেল্টা হসপিটাল, মগবাজারের ইনসাফ বারাকা হাসপাতাল, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইমপালস্ হাসপাতাল এবং গাজীপুরের কেপিজে হাসপাতাল