মিরর বাংলাদেশ : পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পর ঐদিনই গণভবনে লোকে লোকারন্য হয়ে পড়ে। কোথায় থাকতেন হাসিনা তা জানতে উৎসূক জনতা ভিড় জমায় গণভবনে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গণভবন কি হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে নানা ধরনের পর্যালোচনা। এরই মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক প্রস্তাব তুলে ধরেন সিনিয়ির সাংবাদিক মিয়া হোসেন। ৮ আগষ্ট তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, “গণভবনকে গণঅভ্যুত্থান জাদুঘর ঘোষণা করে সেখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ করা হোক‘‘। মিয়া হোসেন দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য। এছাড়া তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবি ও অনেক বইয়ের লেখক।
পরবর্তীতে গণভবনকে জাদুঘর করার জন্য এ প্রস্তাব পাস করানোর জন্য বিভিন্ন সাংবাদিকদের মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছে এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তারেক রহমান গত ২ সেপ্টেম্বর গণভবনকে জাদুঘর করার করার ঘোষনা দেন তিনি। এরপর ছাত্র নেতারাসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি আসতে থাকে এক পর্যায়ে ৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে জাদুঘর সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
গণভবনের জায়গায় গণহত্যা মিউজিয়াম তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তারেক রহমান এই ঘোষণা দেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ষড়যন্ত্র কিংবা অপপ্রচার চালিয়ে গত ১৫ বছরের অনাচার অবিচার জনগণকে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রীয় স্থাপনা গণভবন ছিল বা দেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ঐতিহ্যবাহী স্মারক। গণভবন বা বর্তমানে স্বৈরাচারী হাসিনার দুর্নীতি দুঃশাসন, অনাচার, অপকর্মের প্রতীক। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে এই গণভবনকে গুম খুন অপহরণ এবং গণহত্যার মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এবং গুম হওয়া মানুষদের স্মৃতিগুলো এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত থাকবে। অবৈধ ক্ষমতায় থাকার জন্য বাংলাদেশে আর কোনো শাসক যাতে হাসিনার মতো বর্বরোচিত পথ অনুসরণ না করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই মিউজিয়াম সেই বার্তাই বহন করবে।
গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের পাশাপাশি অন্য প্রস্তাবও দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এক পোস্টে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন পার্থ।
তিনি লেখেন, গণভবন যেহেতু ১৫ একরের বিশাল জায়গা নিয়ে বিস্তৃত সেহেতু গণভবনকে জাদুঘরের পাশাপাশি যদি আবাসন প্রকল্প করে শহীদদের পরিবারকে দেওয়া হয়, আর আহতদের কিংবা গুরুতর আহতদের সুচিকিৎসার পাশাপাশি যদি যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরি দেওয়া যায় তাহলে আমার ধারণা ওনাদের উপকার হতো। ইতিহাস বলে যারা আত্মত্যাগ করে তাদের আমরা স্মরণ করি, কিন্তু মূল্যায়ন করার জায়গায় মনোযোগী হই না। ইমোশন ভালো তবে ইমোশনের সাথে পুনর্বাসন বেশি ভালো।
এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনকে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঐদিন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটা ছিল বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের পঞ্চম বৈঠক। পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত জানান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, গণভবন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতি এবং বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে যত অন্যায়–অবিচার হয়েছে, তার সবকিছু সংরক্ষণ করার জন্য এটাকে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। দ্রুতই এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু হবে জানিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, গণভবন যে অবস্থায় আছে, জনগণ যেভাবে রেখেছেন সে অবস্থায় রাখা হবে। এর মধ্যে ভেতরে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে, যাতে অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে।
তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জাদুঘর নির্মাণের জন্য শিগগিরই একটি কমিটি করা হবে। ৭ সেপ্টেম্বের শনিবার বেলা ১১টার দিকে গণভবন পরিদর্শন করতে যান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
এরইমধ্যে গণপূর্ত ও স্থাপত্যবিভাগের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা তাদের কাছ থেকে প্রাথমিক পরামর্শ নিয়েছি এবং আমাদের আকাঙ্ক্ষার কথাও তাদের জানিয়েছি। এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হয়তো আগামীকালের (রোববার) মধ্যেই কমিটি গঠন করা হয়ে যাবে। কমিটি হলে হয়তো আগামী সপ্তাহ থেকেই আমরা কাজ শুরু করবো। যাতে দ্রুত এটি উদ্বোধন করা যায়, সে জন্য দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কমিটিতে কারা থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা জাদুঘর বিশেষজ্ঞ, স্থাপত্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন তারাই কমিটিতে থাকবেন। সেইসঙ্গে বিদেশ থেকেও জাদুঘর বিশেষজ্ঞ বা এমন অভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের পরামর্শও নিতে বলা হয়েছে।
এখানে কী ধরনের স্মৃতি ধরে রাখা হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের যে ৩৬ দিনের ঘটনাবলি, তার দিনলিপি এখানে থাকবে। আন্দোলনে যারা শহীদ রয়েছেন, তাদের স্মৃতি থাকবে, তালিকা থাকবে। এই আন্দোলন ছাড়াও গত ১৬ বছরে… এই অভ্যুত্থানটা মূলত গত ১৬ বছরের আন্দোলনের মুহূর্ত হিসেবে আমরা ৫ আগস্ট পেয়েছিলাম। তাই এই ১৬ বছরে যে নিপীড়ন হয়েছে, যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদেরও তালিকা থাকবে, যাদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে-এই সব বিষয়ে একটি প্রতিনিধিত্ব জাদুঘরে থাকবে।
সাংবাদিকদের নাহিদ বলেন, অনেক রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ৫ আগস্টের মুহূর্ত পেয়েছি। শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর বুকে এটি নির্দশন হিসেবে রাখতে চাই। যেকোনো স্বৈরাচারী, খুনি, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়কদের কী পরিণতি হয় এবং জনগণই যে ক্ষমতার আসল মালিক সে বিষয়টি একটি নির্দশন হিসেবে পুরো পৃথিবীর বুকে রাখার জন্যই আমরা গণভবনকে জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিনাহিদ বলেন, গণভবন যেই অবস্থায় আছে সর্বোচ্চ সেই অবস্থায় রেখে জাদুঘর নির্মাণের চেষ্টা করা হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি ও নিহতদের ইতিহাস থাকবে এই জাদুঘরে। পাশাপাশি গত ১৬ বছরে যত নিয়মবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন হয়েছে তারও দলিল থাকবে। মানুষের ক্ষোভের উপস্থাপনও থাকবে সেখানে। কিছু ডিজিটাল রিপ্রেজেন্টেশনও থাকনাহিদ ইসলাম বলেন, গণভবন যেই অবস্থায় আছে যে ভগ্ন অবস্থায় আছে, সর্বোচ্চ সেই অবস্থায় রেখে জাদুঘর নির্মাণের চেষ্টা করা হবে। এখানে অনেক দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি আছে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ রেখে গিয়েছে। সেগুলো যতটা সম্ভব রাখা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা থেকে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ ইসলাম বলেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোথায় হবে সেটা পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত হবে। আপাতত সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেখানে (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা) আছেন, সেখানেই থাকবেন।
তিনি আরও জানান, গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা প্রায় শেষ দিকে। এ মাসে শহীদ পরিবারদের নিয়ে স্মরণসভা করা হবে। সেখানে তালিকা ঘোষণা করা হবে। তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। ফাউন্ডেশনের কাজের ঘোষণা হবে। শহীদদের নিয়ে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি আছে সেগুলোর ঘোষণা এ মাসেই হবে।