গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃত্ববাদের বিকাশের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে

65

টিআইবি ও ইউসেনকোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা

* সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন করা সম্ভব : তথ্য উপদেস্টা
*  গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না : ড.ইফতেখারুজ্জামান
*  ভুল তথ্য ও প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় এআই ব্যবহার করা যেতে পারে : কামাল আহমেদ
*  স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে : নোয়াব সভাপতি

মিরর বাংলাদেশ : বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে এক সেমিনার গনমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা বলেছেন, মুক্ত সাংবাদিকতা হোক, মানুষের অধিকার হোক, গণতান্ত্রিক চর্চা হোক, সব কটাকে ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদের বিকাশের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অথচ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না।
রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে ‘ব্রেভ নিউ বাংলাদেশ: রিফর্ম রোডম্যাপ ফর প্রেস ফ্রিডম’ শীর্ষক এসেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করে ইউনেসকো ঢাকা অফিস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুইডেন দূতাবাস।
সেমিনারে সংবাদমাধ্যমের জবাবদিহি থাকার পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকার কথা বলেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের প্রশ্ন করা যাবে, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করা যাবে, গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রশ্ন করা যাবে; কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা যাবে না আমি চাই না, এই জিনিসটা থাকুক।’
মাহফুজ আলম বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের যাঁরা নীতিনির্ধারক আছেন, যেখান থেকে তাঁদের নিউজ বা মতামত তৈরি হয়, সেটাকে অবশ্যই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকা উচিত।
বিটিভি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও বাংলাদেশ বেতারকে একত্র করে একটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার পক্ষে থাকার কথা জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এক করার পক্ষে আমি। তবে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।’
সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তাৎক্ষণিকভাবে করা সম্ভব মন্তব্য করে মাহফুজ আলম বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে “ওয়ান হাউস ওয়ান মিডিয়া” যে নীতির কথা বলা হয়েছে, তা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইনের কিছু কিছু ধারা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বসা দরকার, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পাঠানো দরকার কোনো লুপ হোল আছে কি না জানার জন্য। এটুকুর জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। এরপর আমরা এটি ক্যাবিনেটে তুলব। আইন আকারে যেন আসে, চেষ্টা করব।’
বিজ্ঞাপনের হার পুনর্র্নিধারণের বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত জানিয়ে মাহফুজ আলম আরও বলেন, ডিএফপিতে এটা বাড়ানোর আলোচনা করেছি। তবে যাদের প্রচারসংখ্যা দুই হাজারও না, কিন্তু এক লাখ, দুই লাখ দেখিয়ে রাষ্ট্রের টাকা লুটপাট করেছে, তাদের তথ্য উন্মোচন করা হবে।
দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আখ্যায়িত করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, মুক্ত সাংবাদিকতা হোক, মানুষের অধিকার হোক, গণতান্ত্রিক চর্চা হোক, সব কটাকে ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদের বিকাশের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অথচ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলে না। সংস্থাগুলোয় এখন কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। বাস্তবে কোথাও চর্চার পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তারা যে সিস্টেম ডেভেলপ করেছে, যে মেথড ডেভেলপ করেছে, যে ইনস্ট্রুমেন্ট ডেভেলপ করেছে, যেগুলো করায়ত্ত করেছে, সেগুলো তাদের হাতে বহাল আছে। আমরা সবাই মনে করছি, মোবাইলটা এখন রেকর্ড হয় না। কে নিশ্চয়তা দিতে পারবে এটার?’
বাস্তবিক সংস্কার চাইলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকেও দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, দেশে গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন আছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। সেটার দায়িত্ব তাদের। অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তী যে সরকার আসবে, তাদেরও বুঝতে হবে যে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ম্যান্ডটটা (এখতিয়ার) কী এবং সেভাবেই তাদের কার্যক্রমকে সঙ্গায়িত করতে হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, এখনো সাংবাদিকরা গালাগালির শিকার হচ্ছেন, অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে জরুরি। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে।
কামাল আহমেদ বলেন, অনেকে বলছেন যে, সংবাদমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের যে প্রস্তাব কমিশন করেছে, তা অবাস্তব। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম লাভ করতে পারছে না বা রুগ্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব গণমাধ্যম কোম্পানির মধ্যে যাদের হিসাব রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির দপ্তর থেকে পাওয়া গেছে, তার আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় দেড় ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যম লাভজনক, যা প্রমাণ করে- এ ধরনের রূপান্তর মোটেও অযৌক্তিক নয় এবং তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, মূল সমস্যা হলো বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেনতেনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। পাঠক বা শ্রোতার আকৃষ্ট করতে না পারলেও তারা টিকে থাকার চেষ্টায় বিজ্ঞাপনের দরে অস্বাভাবিক হারে ছাড় দিয়ে পুরো খাতের ক্ষতি করছে।
কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ ও সাংবাদিকদের ওপর বেশিরভাগ হামলার পেছনে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি এবং কথিত মব ভায়োলেন্স কাজ করছে। সরকারের এগুলো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না।
অনলাইনে ভুল তথ্য ও প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস। তিনি বলেন, ‘এখনো গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, তারা অনেক প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে ফিল্টারিং করছেন, এখনো মুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন না।’
গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের কিছুটা এগিয়ে আসা ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে নারীদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার নিশ্চিত করা যাবে না বলেও মনে করেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘যখন সাংবাদিকের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে সাধারণ জনগণও বাকস্বাধীনতা হারায়।’
বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এর সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৬ ধাপ এগোনোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কথা বলার অবস্থা ছিল না। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা ১৬ ধাপ এগিয়েছি। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে ৩২ ধাপ পেছাবো না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে।
এ. কে. আজাদ বলেন, প্রেস কাউন্সিল একটি পঙ্গু ও প্যারালাইজড অর্গানাইজেশন। এর কোনো ভূমিকা নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, আপনার আমার নিরাপত্তা দেবে কে? একজন সাংবাদিক অপরাধ করলে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে মারা যেতে হবে কেন। মুশতাক আহমেদকে (কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ) কেন জীবন দিতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিল তার? এটি নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেছি? কথা বলার অবস্থা ছিল না।
নোয়াব সভাপতি আরও বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতার পর দেখেছি, কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে ফাংশন করতে পারেনি। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এই ১৬ শতাংশ অগ্রগতি আগামী দিনে ৩২ শতাংশ পিছিয়ে যাবে না, তার কোনো গ্যারান্টি আমরা দিতে পারবো?
সেমিনারে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, এএফপির ব্যুরো চিফ শেখ সাবিহা আলম, বিজেসির চেয়ারম্যান রেজয়ানুল হক রাজা এবং টাইমস মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।