গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে কোন যুক্তি খুঁজে পায়নি কমিশন
মিরর বাংলাদেশ : গ্যাস বিতরণ কোম্পানীগুলোর দেয়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা নিয়ে ৪ দিনের শুনানী করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এবারই প্রথম গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বেশি পরিমানে প্রস্তাব আসে কোম্পানী গুলো থেকে। তবে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে খোদ বিইআরসি সমালোচনা করছেন।
সূত্র জানায় গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির যে প্রস্তাব বিতরণ কোম্পানিগুলো দিয়েছে, তা ‘যৌক্তিক, ‘ন্যায্য’ এবং বাস্তব সম্মত’ নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ‘প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের মালিকানা জনগণের। কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে লাভবান হতে চায় কেন?’ শুনানিতে এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল।
শুনানিতে অংশ নিয়ে ভোক্তারা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি আপাতত বন্ধ রেখে, উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে। এছাড়া সিস্টেম লস কমিয়ে, চুরি বন্ধ করে সংকট মোকাবিলা করার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। চুরি বন্ধ করলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দরকার হয় না বলে অভিমত তাদের।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর চার দিনব্যাপী শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার সমাপনী বক্তব্যে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘যারা প্রস্তাবক (কোম্পানি) তারা শুধুমাত্র নিজেদের মার্জিন বাড়ানো বা দাম বাড়ানোর কথা বলেছেন। তবে দাম বাড়লে জনজীবনে অর্থনৈতিক, সামাজিক কী প্রভাব পড়বে, এ বিষয়ে তাদের কোন এনালাইসিস নেই।’
পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর উদ্দেশে আবদুল জালিল বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস রাষ্ট্রের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। যে সম্পদের মালিক জনগণ, তাদের কাছ থেকেই দাম বেশি নিয়ে কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা ন্যায্য নয়।
আবদুল জলিল বলেন, ‘এই শুনানির মাধ্যমে প্রস্তাবকরা জনপ্রত্যাশার কথা জানতে পেরেছে। এখন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পোস্ট হিয়ারিং করে সন্তোষজনক, ন্যায্য এবং বাস্তব সম্মত একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
শুনানিতে উত্থাপিত সব পক্ষের প্রস্তাব, বক্তব্য ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ’ করা হবে জানিয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি যে পেয়েছে তা মোকবিলার জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। কী কী পদক্ষেপ রয়েছে, সব বিকল্প খুঁজে দেখতে হবে। যদি কিছু করা না যায়, তাহলে তো দেখতে হবে।’
জনগণের ক্রয় ক্ষমতা দেখতে হবে উল্লেখ করে আবদুল জলিল বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ কেউ ভিক্ষুকের মতো চলতে চায় না। সবাই রাজার মতোই চলতে চায়। যখন কোন কিছু তার সাধ্যের বাইরে চলে যায়, তখনই সে চিৎকার করে ওঠে। এতদিন টিসিবির গাড়ির পেছনে ভিড় ছিল না। এত লোক দেখিনি। এখন দ্রব্যমূল্যের কারণে ভিড় হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।’
সুশাসন নিশ্চিত করে একটা সহনশীল পর্যায়ে থেকে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে বলেও মন্তব্য করেন আবদুল জলিল।
সব পর্যায়ের গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি (১১৭ শতাংশ বাড়ানোর) করার প্রস্তাব দিয়ে বিইআরসিতে আবেদন করেছিল প্রেট্রোবাংলাসহ এর অধীনস্থ ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিÑ ‘তিতাস, বাখরাবাদ, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল, কর্ণফুলি, সুন্দরবন’। এছাড়া সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল জিটিসিএল।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আবাসিক খাতের গ্রাহকদের দ্বিমুখী চুলার (ডাবল বার্নার) গ্যাসের দাম ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং একমুখী চুলার (সিঙ্গেল বার্নার) গ্যাসের দাম ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০০ টাকা করার সুপারিশ করা হয়। আবাসিক খাতে মিটারে ১২ টাকা ৬০২ পয়সা থেকে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা (১১৫%) করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
বিদ্যুৎ ও সারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা (১২৫%) করার প্রস্তাব দেয়া হয়। শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপটিভে দাম ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা (১১৬) এবং শিল্পে ও চা বাগানে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা (১১৬%) করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে ৫০ টাকা (১১৭%), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে ৩৭ টাকা ২ পয়সা (১১৭%), সিএনজিতে ৩৫ টাকা থেকে ৭৫-৭৬ টাকা (১১৪%) করার প্রস্তাব আসে।
তবে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব প্রায় একই হওয়ায় শুনানিতে প্রশ্ন ওঠে। আবার তথ্যে অসামঞ্জস্য থাকায় সমালোচনার মুখে পড়েন শুনানিতে অংশ নেয়া গ্যাস কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
অতীতে কখনই এত বেশি পরিমাণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি জানিয়ে এবারের প্রস্তাবকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করে ক্যাব। শুনানিতে অংশ নিয়ে ভোক্তাদের কয়েকজন বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? এক লাফে ডাবল!’ অনেকে অভিযোগ করেন, এলপি গ্যাসের বাজার বাড়াতে বাসাবাড়ির রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রক্রিয়া চলছে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন টিম (টিইটি) কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করে সব খাতের গ্যাসের দাম কিছুটা বৃদ্ধির তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কিছুটা কমানোর সুপারিশ করে।
কারিগরি মূল্যায়ন টিম (টিইটি) আবাসিক খাতের গ্রাহকদের দ্বিমুখী চুলার (ডাবল বার্নার) গ্যাসের দাম ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা এবং একমুখী চুলার (সিঙ্গেল বার্নার) গ্যাসের দাম ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা করার সুপারিশ করে।
আবাসিক খাতে মিটারযুক্ত চুলার ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করার সুপারিশ করে টিইটি।
এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪ টাকা ৪৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ৩৪ পয়সা, ক্যাপটিভে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা, সারে ৪ টাকা ৪৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ৩৪ পয়সা, চা শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৫ পয়সা, বাণিজ্যিকে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৬০ পয়সা, সিএনজিতে ৪৩ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে কমিয়ে ১১ টাকা ৪৯ পয়সা করার সুপারিশ করে টিইটি। তবে টিইটির সুপরিশ চূড়ান্ত নয়। বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে কমিশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনা করবে। স্টেক হোল্ডারদের নতুন কোন মতামত, প্রস্তাব থাকলে তাও নেবে কমিশন।
আইন অনুযায়ী, আগামী নব্বই কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনকে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।