জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তোমার হত্যার বিচার চাইবো বোন

1814

 

খাদিজা পারভীন উপমা :

প্রিয় বইনা,কেমন আছো ! কতো দিন দেখা হয়না আমাদের। কতোদিন তুমি রাত- বিরাতে মুঠোফোনে কল করে ঘুম ভাঙাও না আমার, কতোদিন একসাথে কাজ পালিয়ে শাহবাগ, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকা ঘোরা হয়না।

ফেব্রুয়ারী জুড়ে তোমার আমার রুটিনছিলো, রোজ বই মেলায় যাওয়া, অথচ গত হয়ে যাওয়া চার চারটা বই মেলায় তুমি আসোনি।
ছোটবেলা থেকেই তুমি আর আমি ছিলাম মানিক-জোড়, আমাদের পছন্দ অপছন্দও ছিলো কাছাকাছি, সেই ছোটকাল থেকে তোমার সখ ছিলো একটা ঘোড়ার,কেনো ঘোড়া চাও জিজ্ঞেস করলে মিটমিটিয়ে হাসতে তুমি, আচ্ছা তুমি কি ছুটতে ভালোবাসতে!
তুমি ভালো ছবি আঁকতে, ভালো লিখতে, ভালো রেজাল্ট ছিলো তোমার, কত্তো মেধাবী ছিলে তা-ও যখনই কেও জিজ্ঞেস করতো তুমি বলতে “বুবুই আমার আইডল, আমি ওর মতো হতে চাই”
আচ্ছা বলোতো তুমি কেন হতে চাইতে আমার মতো!
ওরা,যখন তোমাকে মালয়েশিয়াতে নিয়ে গেলো,
তুমি বারবার বলতে ” তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে বুবু”
আচ্ছা সত্যিকরে বলোতো আমাদের কথা তোমার মনে পড়ে? আম্মুর কথা, আব্বুর কথা?
আচ্ছা মুগ্ধর কথা! তোমাকে তো বলাই হয়নি, মুগ্ধ আমাকে “মামানি” ডাকে, বেশ পাকা পাকা কথা বলে, বেশ বুদ্ধিও হয়েছে।
শেষের দিকে তুমি বারবার বলতে ” মুগ্ধকে তুমি নিয়ে এসে তোমার কাছে রাখো, তোমার মতো মানুষ করো” তখন পারিনি, তোমার চলে যাওয়ার পর মুগ্ধ এখন “আমার মেয়ে” তুমি খুশি তো!
কিন্তু মাঝে মাঝে ও ভীষন কষ্ট পায়, তোমার জন্য, ওর আম্মুমা’র জন্য, ভীষণ বিদ্রোহী গলায় চেঁচিয়ে বলে ” আমার মা’রে মারলো কেন,ওর মারে মারতে পারলো না, আমার আম্মুমা’রে মারলো কেন”! আমি/ আমরা ওর এসব প্রশ্নের সামনে অসহায় হই, অসহায় তো আমরা বরাবরই বলো!
এই যে তোমার এতো যুদ্ধ শেষে তোমার ঠাঁই হলো দু’টো লাগেজে, আমরা কি কিছু করতে পেরেছি বলো! পারিনি, মানুষ পারেনা, আমরা মধ্যবিত্তরা পারিনা, আমাদের সেই ক্ষমতাই কোথায় বলো!
তুমি বলতে ভালোবাসা দিয়ে সব হয়! হয়েছে কিছু?
কথা ছিলো তুমি ২০১৮ সেপ্টেম্বরে ফিরবে,আমি তোমাকে এয়ারপোর্টে আনতে যাবো। দেখা হলেই ঝুড়ি ঝুরি গল্প। তুমি ফিরেওছিলে, আমিই গিয়েছিলাম আনতে কিন্তু তুমি কথা বললে না,সারাপথ আমরা একসাথে ছিলাম তুমি তোমার হিমঘরের বাইরে আসলে না, কথাও বললে না, জানো সবাই সেদিন রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছিলো তোমার গাড়ীর বলছিলো ” গাড়ী আগে যাক, নইলে এতো লম্বা রাস্তা লাশে পচন ধরে যাবে”
বইনা রে আজ কত্তগুলা দিন তোমার মাটির ঘরটাতে তোমাকে শুইয়ে দিলো সবাই, আমি বেঁচে থেকে থেকে তোমার সাথে ওই ঘরে মাটি চাপা পরে রইলাম, আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা আজকাল, তেমন কোন চাওয়াও নেই।
তোমার মনে আছে বইনা? আমি কোন নতুন জামা কিনলেই ওটা তোমার হয়ে যেতো,আজকাল আমার জামা জুতা আমি একাই পড়ি, কেউ নেয় না কারো সাথে ঝগড়া হয়না আর, তুমি আসবা আর একবার! আসো না বইনা গোয়েন্দা খেলায় আমার সাগরেদ হবা না? থাক এসো না তুমি।

এই নষ্টের দুনিয়ায় তোমার আর আসতে হবেনা। তুমি ঘুমাও।আচ্ছা বইনা, মৃত্যু মানুষ কি সত্যিই সব দেখতে পায়? ওদের কি আপনজনের কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়?

খুনির বিচার হয়নি এখনো।আমাকে যুদ্ধটা শেষ করতে হবে, তুমি নিশ্চিত থাকো, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার হত্যার বিচার চাইবো, মুগ্ধর এতিম হওয়ার বিচার চাইবো, প্রয়োজনে দুনিয়ার সব ঘরের দুয়ারে গিয়ে বলবো “আমি বিচার চাই”।

আমার বোনের হত্যার বিচার চাই।
আইনজীবী সাজেদাই-বুল-বুল হত্যার বিচার চাই।
ইতি তোমার বুবু

উল্লেখ্য, চোখের সামনে তোমার টুকরো হয়ে যাওয়া শরীর দেখেছি, তোমার রক্তহীন কালশিটে পরা ফ্যাকাশে মেডিসিনের প্রেলেপ দেয়া শরীর, মরা মাছের মতো চোখ..

তোমার টুকরো দেহ কবরে রেখেছে নিশ্চিত দেখেছি, কিন্তু তবুও বারবার মনে হয় তুমি বুঝি পৃথিবীর কোন প্রান্তে,কোন সমুদ্র পাড়ের উন্মুক্ত বাতাসে চুল সামলে খলখলিয়ে হাসছো, আমি বুঝি বাতাসে তোমার গায়ের ঘ্রাণ, তোমার হাসির শব্দ শুনতে পাই।

লেখিকা  : ২০১৮ সালে স্বামীর হাতে নৃশংস ভাবে খুন হওয়া সাজেদাই বুল-বুলের বোন “খাদিজা পারভীন উপমা”

ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক,ফ্রীল্যান্সার স্ক্রিপ্ট রাইটার, পেস্ট্রি শেফ।