* ১০ বছর আইনী লড়াই শেষে রায় দিয়েছে ইকসিড * ছাতকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরনের জন্য নাইকোই দায়ী * ক্ষতি পূরণ দিতে হবে গ্যাস ও পরিবেশের * সেপ্টেম্বরে নির্ধারন হবে ক্ষতিপূরণ
মিরর বাংলাদেশ : ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্য নাইকো দায়ী। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ইকসিড নাইকোকে দায়ী করে রায় দিয়েছে। ছাতক গ্যাসক্ষেত্র যত ক্ষতি হয়েছে তার পুরোটা দিতে হবে নাইকোকে। শুধু গ্যাসের ক্ষতি নয়, এর জন্য পরিবেশ এবং মানুষের যে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়েছে তারও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেতে পাওে ৮হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ। ২০০৫ সালে দুই দফায় বিস্ফোরণ হয় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে। ইকসিড রায়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কাজ না করায় বিস্ফোরণ হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক মান ঠিক রাখা হয়নি। আর এজন্যই বিস্ফোরণ হয়েছে। তাই নাইকো এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। এই রায়ের ফলে এখন থেকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র পূর্ণ মালিকানা বাংলাদেশ সরকার পেল।
জানা গেছে, নাইকো দুর্নীতি মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তির প্লাটফর্ম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুটেড (ইকসিড) এই রায় ঘোষণা করেছে। এতে নাইকোর কাছে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পাবে। যদিও ইকসিড স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি নির্ণয় করে বাংলাদেশকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বেলেছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গতকাল রোববার দুপুরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অনলাইনে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এই তথ্য জানান। এই সময় প্রতিমন্ত্রী জানান, দীর্ঘ ১০ বছর আইনি প্রক্রিয়ার পর এই মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। রায় পক্ষে আসাতে সারা বিশ্বের কাছে বার্তা গেছে বাংলাদেশে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে না। গত ২৮ ফেব্রæয়ারি ইকসিড এই রায় প্রদান করে। তবে মার্চের শুরুতে সাংবাদিক সম্মেলন করে এই রায় জানানোর কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির জন্য তা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বলেন, ‘কানাডিয়ান তেল গ্যাস কোম্পানি নাইকো ২০০৩ সালে বিএনপির সময়ে বাংলাদেশের ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান উন্নয়নের কাজ পায়। একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রকে প্রান্তিক দেখিয়ে বিএনপি সরকার নাইকোকে কাজ দেয়। এতে রাষ্ট্রীয় বিপুল পরিমাণ ক্ষতির কথা উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। এই মামলাটি দেশের আদালতে চলমান রয়েছে।’
প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে যে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয় তা ২০১৮ সালে ইকসিডে জমা দেওয়া হয়েছে। ইকসিড রায়ে বলেছে নাইকোর গাফিলতি এবং অদক্ষতার জন্যই বিস্ফোরণ ঘটেছে। ফলে এর দায় নাইকোকেই নিতে হবে। বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামী সেপ্টেম্বরে আবার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি পেছাবে।
মামলাটির আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈন গণি জানান, বাপেক্স এর ১১৮ মিলিয়ন ডলার এবং পেট্রোবাংলার ৮৯৬ মিলিয়ন ডলার মিলিয়ে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এর বাইরে আদালত বলেছে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি এবং পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ক্ষতি নিরুপণ করে আদালতে জমা দিতে। এতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
তিনি আরও জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে আরও একটি শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন করোনার কারণে সেটি সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের পরিস্থিতি ভাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ ঠিক হওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন হতে পারে। এই জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আমরা তাদের দিয়ে পুনঃরায় মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দেবো। এদিকে নাইকো দেউলিয়া হয়ে গেছে। এখন আমাদের বøক-৯ এ বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্রে নাইকোর সম্পত্তি দিয়ে তা উশুল করতে হবে।
এতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কতো ক্ষতিপূরণ পেতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের কাছে ৩০ মিলিয়ন ডলারের গ্যাসের বিল পাবে, এছাড়া বøক-৯ এ নাইকোর সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তি তারা বছর কয়েক আগে ২৮০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে চেয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ এক বিলিয়নের মধ্যে ৩১০ মিলিয়ন ডলারের মতো পেতে পারে।
এই সময় জ্বালানি সচিব বলেন, ‘আমাদেরকে এই অর্থ তাদের দিয়ে দিতে হতো। এখন আর দিতে হচ্ছে না। আবার এর ফলে সারা বিশ্বের কাছেই একটি সুন্দর বার্তা পৌঁছেছে। এটিও বিবেবচনা করতে হবে।
হারতে হারতে বাংলাদেশের জয় যেভাবে:
নাইকো ইকসিডে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল একটি ও ১৬ জুন দুটি মামলা দায়ের করে। মামলা দুটিতে নাইকো ইকসিডের কাছে দুটি বিষয়ে আদেশ চায়। এক. ছাতকের টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের দায় তাদের ওপর বর্তায় কি না এবং বাংলাদেশ ও পেট্রোবাংলা এই ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে কি না। দুই. ফেনী ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম পরিশোধ পেট্রোবাংলা বন্ধ রাখতে পারে কি না।
এই মামলার শুনানির এক পর্যায়ে, ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নাইকোর গ্যাসের দাম পরিশোধ সংক্রান্ত মামলাটির রায় ঘোষণা করে ইকসিড। সেখানে পেট্রোবাংলাকে ২৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওযা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষে মামলা পরিচালনায় ত্রæটির কারণে নাইকোর কাছ থেকে বিস্ফোরণের কারণে যে পরিমাণ গ্যাস পুড়ে গেছে তার দাম পাওয়ার বিষয়টি ফিকে হয়ে আসছিল। এর মধ্যে নাইকো টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননের জন্য নিরাপত্তা জামানত হিসেবে রাখা টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেয়। কুমিল্লা অঞ্চল নিয়ে গঠিত স্থলভাগের ৯ নম্বর তেল-গ্যাস বøকে তাদের নাইকোর যে শেয়ার ছিল তাও বিক্রি করার চেষ্টা করে।
এই অবস্থায় সরকার নাইকোর সঙ্গে চুক্তিটিকে অবৈধ আখ্যায়িত করে সেটি বাতিলের জন্য নতুন মামলা করার উদ্যোগ নেয় ইকসিডে।এ জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল চারবার লন্ডন সফর করেন। এর আগে এই মামলার আইনজীবি ছিলেন আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজ, তিনি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির স্বামী। তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তরুন আইনজীবি মইন গনিকে মামলার আইনজীবি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মামলায় নিয়োগ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফলি হক ‘ল’ ফার্মকে। প্রসঙ্গত, বাপেক্সের আইনজীবি ছিলেন ব্যারিস্টার কামাল হোসেন। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কামাল হোসেনকে বাপেক্সর আইনজীবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নাইকোর পক্ষে আইনজীবি ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নতুন করে তথ্য উপাত্য উপস্থাপন শুরু হয়।
ইকসিডের মামলা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এমন একজন ব্যক্তি বলেছেন, ইকসিডে মামলা পরিচালনায় ত্রæটির জন্য সরকার প্রায় হারতে বসেছিল। মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করলে এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ পক্ষ থেকে সঠিকভাবে মামলাটি আদালতে উপস্থাপন ও পরিচালনা করা হয়নি। পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষেও অনেক কথা বলা হয়েছে, সেসবের সবকিছূর রেকর্ডও ইকসিডে আছে। এর সঙ্গে সরকারেরই কিছু লোক জড়িত। অন্যদিকে ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের দাম পরিশোধে দেওয়া ইকসিডের রায় বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে তিন মাস সময় বেধে দেয়।
এরকম পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালে সরকারি তৎপরতার বাইরে উচ্চ আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে মামলা করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। আদালতের কাছে তিনি দুটি প্রতিকার চান। একটি হলো, নাইকোর সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ও বিস্ফোরণের কারণে ক্ষতিপূরণ আদায়। আদালত নাইকোর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার র্নিদেশ দেয় এবং বাংলাদেশের কাছে নাইকোর বিক্রির অর্থ ২৭ মিলিয়ন ডলার না দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়। থেমে যায় নাইকোর গ্যাস বিল দেওয়ার প্রক্রিয়া
প্রসঙ্গত, গ্যাসকূপ খনন করার সময় ২০০৫ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি ছাতকে প্রথম দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আবার চেষ্টা করতে গেলে আরও এক দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে খনিটিতে থাকা গ্যাসের অনেকটা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র বিলুপ্ত হয়। এখনও ছাতকে এই গ্যাস ক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকায় গ্যাস উদগীরণ ঘটছে। ##