* র্যাবের দাবি শিগগিরই চার্জশিট
* মেধাবী এই ছাত্রের হত্যাকান্ডের সাত বছর পূর্তি হচ্ছে আজ ৬ মার্চ।
* ২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকী
* নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়।
* ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার।
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। মামলাটির তদন্তও শেষ হয়নি।
নিহত ত্বকীর স্বজন ও নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিযোগ, জেলার একটি প্রভাবশালী পরিবারের কারণে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে না।
তবে , মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব দাবী করছে , তদন্ত শেষ হচ্ছে। শিগগিরই এই হত্যা মামলার চার্জশীট আদালতে দাখিল করা হবে।
ত্বকী হত্যাকান্ডের সাত বছর পূর্তি হচ্ছে আজ ৬ মার্চ। এ উপলক্ষে চার দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ । কর্মসুচীর মধ্যে রয়েছে , প্রতি বছরের মতো এবারও খুনীদের বিচার দাবি করে ত্বকী স্মরণে আজ ৬ মার্চ থেকে শিশু সমাবেশ, শিশু-কিশোরদের চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকসহ চারদিন ব্যাপী নানা কর্মসূচী। এ ছাড়া, আজ সকালে ত্বকীর কবর জিয়ারত ও ফাতিহা পাঠও রয়েছে।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকী নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়। ওই দিন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ৮ মার্চ সকালে ত্বকীদের বাসার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে র্যাব ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে সুলতান শওকত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। প্রথমে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করে। পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন ত্বকীর বাবা। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে র্যাব মামলার তদন্ত শুরু করে।
এ হত্যাকান্ডের প্রথম বার্ষিকীতে ২০১৪ সালের মার্চে র্যাব সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, ত্বকী হত্যাকান্ডে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। যেকোনো দিন এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চেও অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়েনি।
আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জের প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে ও আওয়ামী লীগ নেতা সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক অনন্য নজির ?
আলোচিত স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যাকাÐের পর দীর্ঘ সাত বছরেও চার্জশিট আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র্যাব। গ্রেফতার হয়নি এর সাথে জড়িত খুনীরা। এরমধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাÐটি পড়ে গেছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ঘোরটোপে। এ নিয়ে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সর্বত্রই একটা চাপা ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে।
আলোচিত ওই হত্যাকাÐকে সামনে রেখেই সর্বশেষ অগ্রগতি কী, তা জানাতে ৪ মার্চ রাতে র্যাবের স্থানীয় ব্যাটালিয়নের মিডিয়া উইং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন মুখোমুখি হয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীদের। তিনি এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদেরকে জানিয়েছেন, তদন্তে অগ্রগগি হচ্ছে। শিগগিরই এ হত্যার চার্জশিট প্রদান করা হবে।
মামলাটির চার্জশীট প্রদানে বিলম্বের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে বেশ কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাবকে। ফের নতুন করে তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখতে হয়েছে বিধায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
কালক্ষেপণ হলেও বর্তমানে মামলাটির তদন্ত অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে আলেপ উদ্দিন আশা প্রকাশ করে বলেন, যতো দ্রæত সম্ভব তদন্তকাজ সম্পন্ন করে চার্জশিট প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং খুব শিগগিরই তা আদালতে দাখিল করা হবে।
এর আগে হত্যাকান্ডের এক বছর পর ঢাকায় র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত খসড়া চার্জশিটটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তাই আমি কিছু বলতে পারব না।
তবে, তদন্তের বর্তমান অগ্রগতি এবং যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তারা এর সাথে জড়িত কিনা, এসম্পর্কে জানতে চাইলে র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে আগাম কোনো কিছুই এখন বলা সম্ভব নয়।
এদিকে সাত বছর পূর্ণ হলেও র্যাব এখন পর্যন্ত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করতে না পারায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত ত্বকীর পরিবারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। হত্যায় অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বলে দাবি করছেন ত্বকীর পরিবার। তবে সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে আলোচিত এই হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষসহ নাগরিক সমাজের নের্তৃবৃন্দ।
ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, ত্বকী হত্যার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই র্যাব খসড়া চার্জশীট প্রকাশ করেও চূড়ান্তভাবে সেটি দাখিল করতে পারলো না। তিনি দুঃখ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, বড় কোনো ঘটনার ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত দিলে তা বাস্তবায়ন হয়। সিদ্ধান্ত না দিলে বাস্তবায়ন হয় না। তেমনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী চাইলে ত্বকী হত্যার বিচার হবে। না চাইলে বিচার হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে রফিউর রাব্বি বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সমস্ত শিশু হত্যার সুষ্ঠু বিচারের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমি আশা করি ত্বকী হত্যার বিচারও তিনি করবেন। সমস্ত নারায়ণগঞ্জবাসী তাকিয়ে আছে তার দিকে।
নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায় বলেন, এমন একটি মেধাবী ছাত্রকে হত্যা করা হলো অথচ রাষ্ট্র এর কোনো সুবিচার করছে না। দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। এভাবে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না।
ত্বকী হত্যার বিচার এখন পর্যন্ত না হওয়ার কারণে রাষ্ট্র ও সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। ভবানী শংকর বলেন, ছয় বছর যাবত আমরা সরকারের কাছে ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আসছি। যতদিন পর্যন্ত বিচার না হবে ততদিন পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বো না।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব কবি হালিম আজাদ বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্বকী হত্যার বিচার না হলেও সামাজিকভাবে বিচার হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জবাসি জানে কারা ত্বকীকে হত্যা করেছে। তাদের প্রতি সবাই ঘৃণা প্রকাশ করছে। এটাই সামাজিক বিচার। হালিম আজাদ বলেন, বিচার হয়নি বলে আমরা হতাশ নই। আমরা এখনো আশাবাদি। রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্বকী হত্যার বিচার একদিন না একদিন হবেই। আমরা সেই প্রত্যাশায় থাকবো।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়াটা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। কোন গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে এমন একটি হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর থেমে থাকতে পারে না। এতে প্রমান হয়, দেশে এখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ত্বকী হত্যাকান্ডে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী গডফাদাররা জড়িত থাকায় এর বিচার হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সরকার ত্বকী হত্যার সুবিচার করে দেশে সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
২০১৩ সালের ৬ই মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের পুরাতন কোর্ট এলাকা থেকে অপহরণের পর হত্যা করা হয় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মেধাবি শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। দুইদিন পর ৮ মার্চ পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনি খাল থেকে। এ ঘটনার পর ওইদিনই নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি সদর থানায় বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে লিখিত অভিযোগ দেন। এর দশদিন পর ১৮ মার্চ রফিউর রাব্বি সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সহ-সভাপতি রাজীব দাশ, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাতকে আসামী করে সম্পূরক এজাহার দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের তদন্ত সন্তোষজনক না হওয়ার মামলার বাদি রফিউর রাব্বি উচ্চ আদালতে রীট করলে আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুন:তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাবকে।
হত্যাকান্ডের এক বছরের মাথায় তদন্ত সংস্থা র্যাব তদন্ত করতে গিয়ে ত্বকী হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাংসদ শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ উল্লেখিত ছয়জনের কোন সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে নতুন করে প্রাক প্রস্তুতিমূলক একটি আসামীর তালিকা তৈরি করে। তাতে উল্লেখ করা হয় শামীম ওসমানের বড় ভাই সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নের্তৃত্বেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়।
র্যাবের ওই তালিকায় আজমেরী ওসমান, তার সহযোগি ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, শিপন জামশেদ ও কালাম শিকদারসহ ১১ জনের নাম উঠে আসে। এদের মধ্যে র্যাব এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করলেও বর্তমানে তারা জামিনে এবং অন্যরা পলাতক রয়েছে। তবে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সুলতান শওকত ভ্রমর ও ইউসুফ হোসেন লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও তাদের বক্তব্য দুই রকম হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়াও তদন্তকালে শহরের কলেজরোড এলাকায় কথিত টর্চারসেল নামে আজমেরী ওসমানের ব্যক্তিগত কার্য্যালয়ে অভিযানে যুবকের রক্তমাখা জামাকাপড় উদ্ধার হলে র্যাব সেটি ত্বকীর বলে জানালে আরেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কারণ, কুমুদিনি খাল থেকে শার্ট প্যান্ট পড়া অবস্থাতেই ত্বকীর লাশ উদ্ধার হয়েছিল। ত্বকীর পোশাক পরিহিত লাশের সেই ছবিসহ এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে ত্বকী হত্যায় মূলত কারা জড়িত?
পরে র্যাব ত্বকী হত্যার বিষয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ওই খসড়া চার্জশীটের বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে প্রকাশ করে শীঘ্রই চূড়ান্ত চার্জশীট দাখিল করার কথা জানায়। এরপর ছয় বছর অতিবাহিত হলেও তদন্ত সংস্থাটি এখন পর্যন্ত এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি