না`গঞ্জে ১০ মাস পর তানজিনা হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই

373

* স্ত্রীকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেয় ঘাতক রাসেল

নিয়াজ মোহাম্মদ মাসুম , নারায়ণগঞ্জ :
প্রথমে দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। পরবর্তীতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে তা ঢুকিয়ে রাখা হয় ফ্রিজে। সুযোগ মতো একটি একটি টুকরো ফ্রিজ থেকে বের করে ফেলা দেয় পাশবতী পুকুরে। তানজিনা আক্তার(২৮) নামের এক তরুনীকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বামী রাসেল।
ঘটনার ১০ মাস পর তানিজনা হত্যার রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ শাখা। একই সাথে বৃহস্পতিবার পুকুরের পানি সেচে একের পর এক উদ্ধার করা হয় তানজিনার টুকরো টুকরো করা দেহের হাঁড়গুলো। এর আগে গত ২২ ফেব্রæয়ারি গ্রেফতার করা হয় তানজিনার ঘাতক স্বামী রাসেলকে। তার দেয়া স্বীকারোক্তিতে উদ্ধার করা হয় তানজিনার দেহের টুকরো টুকরো অংশ।
রাসেলের মুখে তার স্ত্রী হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে পিবিআইর কর্মকর্তারাও হতভম্ব । গা শিহরে উঠার মতো বর্ণনা শুনে অনেকে স্তম্বিত হয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো: নুর মহসীনের আদালতে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাকারোক্তিমুলক জবান বন্দি দেয় ঘাতক রাসেল।
তানজিনা (২৮)। সে রংপুর জেলার আ. জলিলের মেয়ে। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার এনায়েতপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে রাসেল মিয়ার সঙ্গে তানজিনার বিয়ে হয়েছিল। তারা স্বামী স্ত্রী ফতুল্লার মাসদাইর বাড়ৈভোগ এলাকার সিরাজ খানের বাসায় ভাড়া থাকতেন। সেখানে পারিবারিক কলহে ঝগড়া করে রাসেল তার স্ত্রী তানজিনাকে গলা কেটে হত্যা করে।
জানা যায়, ২০২১ সালে ৫ এপ্রিল ওই ডোবা থেকে তানজিনার দেহবিহীন মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ মামলা করে। এ মামলা পিবিআই তদন্ত পেয়ে রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করে। তখনও তানজিনার পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ পিবি আই উপপরিদর্শক (এসআই) শাকিল হোসেন বলেন, রাসেল তার স্ত্রীর দেহ কয়েক টুকরো করে বাড়ির পাশের ওই ডোবায় ফেলে দেয়। তখন রাসেল তার বাড়িওয়ালা সিরাজ খানকে জানান তার স্ত্রী তানজিনা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। এর পর সে বাসা ছেড়ে চলে যায়।
তিনি আরও জানান, গত ২২ ফেব্রæয়ারি রংপুর থেকে রাসেলকে গ্রেফতারের পর জানা যায় মাথাটি যে ডোবায় পাওয়া গেছে, সেখানেই দেহ কয়েক টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এতে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ডোবায় সেচ মেশিন দিয়ে পানি সরানোর পর একের পর এক উদ্ধার করা লাশের টুকরো টুকরো হাড় গুলো।
পিবি আই এর নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, রাসেলের সঙ্গে তানজিনার প্রেম ছিল। পরে তারা স্বামী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু পরকীয়ার কারণে তাদের সংসারে কলহ দেখা দেয়। ২০২১ সালের ২৯ মার্চ তানজিনাকে ঘরে থাকা বটি দিয়ে গলা কেটে ও শরীরের অংশগুলো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেয় রাসেল। ৪ এপ্রিল বস্তাবন্দী করে সেগুলোও পাশের ডোবায় ফেলে দেয়। ঘটনার পর হত্যায় ব্যবহৃত বটি ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে ওই বাড়ি থেকে চলে যান রাসেল।
পিবিআই জানায়, ফতুল্লা থানাধীন বাড়ৈভোগ বটতলা ডোবার মধ্যে গতবছর ৫ এপ্রিল অজ্ঞাত মহিলা(২৮)’র খন্ডিত মাথা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে থানা পুলিশ অজ্ঞাত মহিলার গলা কাটা মাথা উদ্ধার করে বিধি মোতাবেক সুরতহালের পর ময়না তদন্ত করেন।
ফতুল্লা থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। মামলা নং- ১৯, পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে দেয়ায় হয়ে । প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার বদলির কারনে পরবর্তীতে পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) সাইফুল আলম মামলাটি তদন্ত শুরু করেন।
তদন্তকালে তিনি তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গত ২২ ফেব্রæয়ারি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার এনায়েতপুর হতে মোঃ রাসেল (২৯), পিতা- হাবিবুর রহমান, সাং- কুমুরগঞ্জ, থানা- মিঠাপুকুর, জেলা- রংপুরকে গ্রেফতার করে পিবি আই, নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে হাজির হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত আসামী স্বীকার করে যে, গলাকাটা মাথাটি তার স্ত্রী তানজিনা (২৮), পিতা- মোঃ আঃ জলিল, সাং- চিথলী, থানা- মিঠাপুকুর, জেলা-রংপুর এর খন্ডিত মাথা।
রাসেল পুলিশকে জানায়, ২০১৯ সালে ভিকটিম তানজিনা এবং আসামী রাসেল স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম দেওভোগ আদর্শ নগর রঙ্গিলা রোডস্থ মোঃ নোয়াব এর বাড়ীর ৩য় তলায় বাসায় বসবাস শুরু করে। কিন্তু বিবাহের পর থেকেই ভিকটিম তানজিনা আসামী রাসেল এর মৃত বোনের স্বামী মোস্তফা সহবিভিন্ন পর পুরুষের সাথে গোপনে কথা বলা শুরু করে। উক্ত বিষয়ের সূত্র ধরে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। গত বছর ২৯ মার্চ রাত অনুমান ০৩:০০ ঘটিকায় রাসেল শবে বরাতের নামাজ শেষে বাড়ী ফিরে ভিকটিম তানজিনাকে অন্যত্র মোবাইলে কথা বলতে দেখে রাগান্বিত হয়ে ভিকটিমকে মারপিট শুরু করে। এক পর্যায়ে আসামী রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ঘরে থাকা রান্নার কাজে ব্যবহার করা বটি দিয়ে তানজিনার গলায় আঘাত করে। এতে তার গলা কেটে রক্ত বের হয় এবং সঙ্গা হারিয়ে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পরে। পরে আসামী বটি দিয়ে ভিকটিমের ধর থেকে মাথা কেটে আলাদা করে ফেলে। এবং হাত পা সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেয়।


পরে বিভিন্ন সময়ে খন্ডিত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ তার বাসার ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ময়লার স্তুপের মধ্যে ফেলে দেয়। সর্বশেষ গত বছর ৪ এপ্রিল গভীর রাতে ভিকটিমের খন্ডিত মাথা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভর্তি করে দেওভোগ বাড়ীর পিছনে ডোবার মধ্যে ফেলে দেয়। এই ঘটনার পরে আসামী তার ভাড়া বাসা ছেড়ে হাড়ি পাতিল ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত বটি নিয়ে গোপনে পালিয়ে যায় এবং সোনারগাঁ থানাধীন ছোট সাদিপুর এলাকায় জনৈক ফিরোজ হোসেনের একটি টিন সেড ঘর ভাড়া নেয়। পরবর্তীতে ভিকটিমের আত্মীয় স্বজন তার খোঁজ খবর না পেয়ে ভিকটিম তানজিনার ভাগিনা পলাশ ফতুল্লা থানায় একটি নিখোঁজ জিডি করে।
উক্ত জিডির সূত্র ধরে থানা থেকে আসামীকে ফোন দিলে সে সোনারগাঁ থেকে পালিয়ে যায় এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে উক্ত আসামী রাসেল বিভিন্ন সমযে নামে বেনামে ২৫(পঁচিশ) টি মোবাইল এবং ১৫ (পনের) টি সিম ব্যবহার করে এবং তার অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে।
আসামীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার ভাড়া বাসা থেকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত বটি ও মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত ফ্রিজ উদ্ধার পূর্বক জব্দ করা হয়। ভিকটিম তানজিনার ব্যবহৃত মোবাইলটি ধৃত আসামী রাসেলের বোন আশার হেফাজত থেকে উদ্ধার পূর্বক জব্দ করা হয়। আসামীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভিকটিমের দেহের অন্যান্য খন্ডিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং তার অংশ বিশেষ উদ্ধার করা হয়।