জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংবাদিক সম্মেলন
* আমরা রাজনৈতিক দল নই, তবে আমাদের উদ্যোগ রাজনৈতিক
মিরর বাংলাদেশ : সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, আমরা রাজনৈতিক দল নই, তবে আমাদের উদ্যোগ রাজনৈতিক। গত জুলাইয়ে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সেখানে হাজারের কাছাকাছি ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়, সে জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটির আত্মপ্রকাশ।
শনিবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তারা।
লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত থেকে মুক্ত হয়। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় সারা দেশের জনগণের মুক্তির আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার কাছে পরাজিত হয় ফ্যাসিস্ট শক্তি। এই আন্দোলনে হাজারের কাছাকাছি মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের এই সাহসী আত্মত্যাগই বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করছি। কিন্তু এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের যে, এতদিন পরও আমাদের মধ্যে কোনও ইস্যুতেই জাতীয় ঐক্য নেই। সবকিছু নিয়েই আমরা দ্বিধা-বিভক্ত। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় কাজও এখানে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সুযোগ নেয় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এ কারণে স্বাধীনতার এত দিন পরও আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কী প্রক্রিয়ায় তা নিয়েই এতদিনে কোনও ঐক্যে পৌঁছানো যায়নি। আমাদের এই নাগরিক কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, জনগণসহ সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাতীয় ঐক্য তৈরি করা।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনও বিলোপ হয়নি। ফ্যাসিবাদ একটি সরকার নয়। এটি একটা ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন আইন, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক চর্চার মাধ্যমে টিকে থাকে। আমরা সেই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চাই। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরিতে কাজ করবে নাগরিক কমিটি। এমন একটি বন্দোবস্ত আমরা তৈরি করতে চাই, যাতে সামনের দিনে কোনও সরকার প্রধানকে শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যেতে না হয়।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি তরুণদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা সামনের দিনের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তরুণসহ সব নাগরিককে এই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করতে চাই। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে জনগণকে আমরা সম্পৃক্ত করতে চাই। মানুষের মধ্যে যেই গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তাকে বাস্তবতায় পরিণত করতে চাই আমরা।’
এরই মধ্যে সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। আমরাও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্রিত করে প্রস্তাবনা তুলে ধরবো কমিশনের কাছে। আমরা চাই, কমিশনগুলো তাদের কাজের সময় আন্দোলনরত সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজ করবে। যেন ঐক্যমত্যের মধ্য দিয়ে এসব সংস্কার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।’ যোগ করেন সামান্তা শারমিন।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট পতনের এক মাসের ওপর সময় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও শহীদদের নামের তালিকা সম্পূর্ণ করেনি সরকার। এ বিলম্ব গ্রহণযোগ্য নয়। আহত অনেকে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। প্রতিদিনই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর আসছে। সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সব শহীদ ও আহতদের নামের তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। আহতদের জন্য সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে ফ্যাসিবাদী শক্তির পূর্ণবাসন প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে আমরা সজাগ আছি।’ একইসঙ্গে এ বিষয়ে জনগণকে সজাগ থাকারও আহ্ববান জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি আছে কিনা এবং কতো জন আছে, কে কোন সংগঠনে আছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সামান্তা শারমীন বলেন, ‘এ রকম কেউ আমাদের সংগঠনে নেই। তবে এখানে যারা আছেন, তাদের বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সবার রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আছে। আগের কোনও পদপদবি এখানে মূখ্য বিষয় নয়।’
অন্তর্র্বতী সরকারকে সময় বেঁধে দেওয়া হবে কিনা প্রশ্নে মুখপাত্র বলেন, ‘এই সরকারকে আমরা কাজ করার সুযোগ দিতে চাই। কিন্তু আমার চাইবো মন্থর গতিতে যেন কার্যক্রম না চলে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার চাইবো।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।’‘এই সংবিধান একদলীয় সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গঠন করা হয়েছে। যেটাতে গণমানুষের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়নি। সংবিধান পুনর্গঠন নাকি সংশোধন করা উচিত এর জন্য গণ-আলোচনার আয়োজন করা হবে। জনগণের অভিপ্রায় যেটা, তার মাধ্যমে সংবিধান লেখা হবে।’
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি এক্টিভ কিনা এই প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সব কার্যক্রম স্থগিত। ক্যাম্পাসে যেহেতু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ছাত্রা রাজনীতি চায় না, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কী হবে তা পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। তবে আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের একটা অংশ ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে। কারণ, তারই ভবিষ্যতে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটি কেন গঠন করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে নেতারা বলেন, ছাত্র নাগরিকদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন হয়েছে। এখনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও ছিলেন। কিন্তু দেখা গেছে, বিএনপি বলেছ তাদের এতজন মারা গেছে, জামায়াত বলছে, তাদের ওতজন মারা গেছে। তাহলে সাধারণ যে নাগরিক মারা গেছে, তাদের কী হবে! নাগরিকদের এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘোষিত আট দফা বাস্তবায়নে অচিরেই নাগরিক কমিটি সারা দেশে জনসংযোগ কার্যক্রম শুরু করবে জানিয়ে আত্মপ্রকাশের আট দফা তুলে ধরে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এগুলো হলো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া সামষ্টিক অভিপ্রায় ও গণতান্ত্রিক আকাক্ষাকে সমুন্নত রাখা, ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা,রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও জবাবদিহির পরিসর তৈরি করা; বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় ও গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সংহত করার লক্ষ্যে কাজ করা, দেশের সর্বস্তরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে সংহত করে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা সমুন্নত করে রাখার লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা,জনস্বার্থের পক্ষে নীতি নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সংলাপের আয়োজন করা; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণী প্রস্তাবনা তৈরি ও সেটা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষপে নেওয়া,গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণ-আলোচনার আয়োজন করা। *****