৩ মাসের ৮২৩৫টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও ২২৪৬৯টি বার্নার সংযোগ বিচ্ছিন্ন
মিরর বাংলাদেশ দেশে প্রতিবছর চুরি হয় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস। নতুন গ্যাসের অনুসন্ধান না পেলে মজুদ আগামী ৯ বছরে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, বিগত দিনে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবস্থা নাজুক।
প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর দৌড়ে ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকার। যার কারণে সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৬৭ ভাগ অবকাঠামো অলস বসে আছে। আর গুণতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ, বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও ভোক্তা ব্যয়। অন্যদিকে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ। বাড়েনি নিজস্ব কয়লার ব্যবহারও।
জানা গেছে , ৬০ ভাগ গ্যাস ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে। চুরি হয় প্রায় ১০ ভাগের মত। ২০৩০ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদা বেড়ে ৫০০ কোটি ঘনফুট দাঁড়াবে। উত্তোলন না বাড়লে এলএনজি নির্ভরতায় দাম হবে দ্বিগুণ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, ‘১২ ডলার এলএনজি যেটা আমি কিনছি, যদি হিসাব করি তাহলে যে গ্যাসটা আমাদের হারিয়ে যাচ্ছে এটার দাম প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। ১ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর। আপনি যতকিছুই বলেন না কেন, অনেক ইন্ডাস্ট্রিতেই দুই নম্বরি হচ্ছে।’
আরেক বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘অবশ্যই এখানে রাজনৈতিক পক্ষপাত ছিল। পাশাপাশি ছিল দুর্নীতি। এই দুটো জিনিস এতো বেশি ডমিনেট করেছে যে, যেটা টেকনিক্যালি ডিটারমিন হওয়ার কথা ছিল হয়নি। এ কারণেই আজকে আমরা এ অবস্থায় এসে পড়েছি। এখান থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন।’
জ¦ালানী উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বড় দুটি সমস্যা আমরা দেখছি। একটা হচ্ছে প্রতিযোগিতার অভাব, আরেকটা হলো অপচয়। দুটি সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। সরকারি খাতের ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতার অনেক অভাব রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমরা এখন যেখানে যেটা পারছি, উন্মুক্ত (প্রতিযোগিতামূলক) করে দিচ্ছি। আপনারা (ব্যবসায়ীরা) বিশেষ করে জ্বালানি খাতে এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেন।’
এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, দিনে পাঁচ-সাতবার করে গ্যাসের সরবরাহ চলে যাচ্ছে। এতে পণ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস না থাকার অন্যতম কারণ সিস্টেম লস। সিস্টেম লসের নামে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ গ্যাস চুরি হয়। এটি বন্ধ করতে হবে। যারা এত বছর ধরে চুরি করেছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি আমাকে গ্যাস দেন, আমি আপনাকে বৈদেশিক মুদ্রা দেব। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে চীন থেকে অনেক বিনিয়োগ স্থানান্তর হবে। কিন্তু জ্বালানি–সংকট থাকলে এসব বিনিয়োগ ধরা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে হিমশিম খাচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে; হামলায় তিতাসকর্মীদের আহত হওয়া এবং অবরুদ্ধ হয়ে উচ্ছেদ করা লাইন পুনঃসংযোগ দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জসহ তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ সংযোগ চলছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ এবং পরবর্তীতে আবার অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা নতুন নয়। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ সংযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ বাণিজ্যের নেপথ্যে স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাশালীদের পাশপাশি, প্রশাসন, পুলিশ, ঠিকাদার এবং তিতাস কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও যুক্ত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে অনেক এলাকায় অবৈধ সংযোগ বিস্তার লাভ করেছে। সূত্র জানায়, বড় পরিসরে কয়েকটি অভিযানের পর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ মুক্ত ঘোষণা করেছিল তিতাস গ্যাস কোম্পানি। তবে ৫ আগস্টের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ভবেরচর, বাউশিয়া, জামালদী, আনারপুরাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট থেকে পুনরায় অবৈধ সংযোগ চালু করা হয়। কাটা যাওয়া লাইন পুনরায় সংযোগ দিতে স্থানীয়দের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়।
সোনারগায়ের বাসিন্দা মাসুম মাহমুদ বলেন, ‘চাইর-পাঁচ মাস আগে লাইন কাইট্টা দিছিল। এইবার নতুন লাইন দিতে তিন হাজার টাকা দিছি। হেগো জিগাইছি… কইছে ছয় মাস নিশ্চিন্ত থাকেন; লাইন কাটবো না। আমার কথা অইল, এলপি গ্যাসে মাসে যেই খরচ, তিন মাসও যদি লাইনের গ্যাস পাই, আমার ট্যাকা উসুল।’ স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর স্থানীয়দের কাছে টাকা তুলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর কয়েকটি এলাকায়ও পুনরায় অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়।
এদিকে সাভারে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিছিন্ন করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এসময় ৩টি পয়েন্টে ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩ শতাধিক বাসাবাড়ি ও একটি অবৈধ মশার কয়েল কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিছিন্ন করা হয়। এছাড়াও এসময় অবৈধ সংযোগ নেয়ার অভিযোগে ওই অবৈধ মশার কয়েল কারখানাটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
গত বুধবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দিনব্যাপী উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। ১৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বকেয়া থাকায় ১৪ টি বাড়ির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। অতিরিক্ত চুলা ব্যবহারের জন্য ১৭ টি বাড়ির ১০৪ টি ডাবল চুলা এবং ১টি সিঙ্গেল চুলার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ব্যবহারের জন্য ৮ বাড়ির রাইজারের সংযোগ বন্ধ করা হয়।
তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানানো হয়, গত সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে ১০৮টি শিল্প, ৬২টি বাণিজ্যিক ও ৮০৬৫টি আবাসিকসহ মোট ৮২৩৫টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও ২২৪৬৯টি বার্নার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে দৈনিক ৫৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৮১ ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। এসব অভিযানে তিতাসের নকশা বহির্ভূত ৫১ কিলোমিটার অবৈধ পাইপ লাইন অপসারণ করা হয়।
বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। এর মধ্যে গড়ে ৩০০০ এমএমসিএফ সরবরাহ করা হয়।
গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কমছে উৎপাদন। বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ১৯৬০ এমএমসিএফ। আর কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি (তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস) থেকে সরবরাহ সক্ষমতা ১১০০ এমএমসিএফ। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮২০ এমএমসিএফ। এতে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৭৮০ এমএমসিএফ।
অবৈধ সংযোগ বেশী তিতাসে
রাষ্ট্রীয় ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস বিতরণ করা হয় তার প্রায় ৫৫ শতাংশ বিতরণ করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় গ্যাস বিতরণ করে এই কোম্পানি।
২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, তিতাসের মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৭। এরমধ্যে, আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩। বাকি যেসব সংযোগ রয়েছে তারমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৬টি, সার কারখানা ২টি, শিল্প সংযোগ ৫৪২৯টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৭৫৫টি, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ৩৯৬টি, বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ১২ হাজার ৭৮টি।
কোম্পানির তথ্য এবং স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, তিতাসের আওতাধীন অঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে জালের মত ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। আবাসিক ভবনের ওপর তলা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা এমনকি ক্যাপটিভ পাওয়ারেও এর বিস্তৃতি। অবৈধ সংযোগে গ্যাস চুরির কারণে তিতাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশ।
অবৈধ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার শনাক্তকরণ এবং উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের লক্ষ্যে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশান, ময়মনসিংহ, মেঘনাঘাট ও নরসিংদী এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এবং কোম্পানির জনবল দ্বারা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত ১৪ ও ১৭ নভেম্বর কেরানিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ০৪টি শিল্প, ০১টি বাণিজ্যিক ও ৭৭টি আবাসিক গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গনমাধ্যমকে বলেন, পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সম্প্রতি কার্যক্রম জোরদার করেছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করতে না পারলে সিস্টেম লস থেকে বের হওয়া যাবে না।