মিরর বাংলাদেশ: বরগুনার আমতলী থানায় পুলিশ হেফাজতে থাকা হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি শানু হাওলাদার মারা গেছেন। পরিবারের দাবি তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশের দাবি সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমতলী থানার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রীর কক্ষের সিলিংফ্যানে রশিতে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় তার মরদেহ ঝুলছিলো।
বৃহস্পতিবার সকালে রশি কেটে তার মরদেহ নামানো হয়েছে।
এ ঘটনায় আমতলী থানার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রী ও ডিউটি অফিসার এসআই আরিফকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন-পিপিএম তাদেরকে বরখাস্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আমতলী থানার ওসি আবুল বাশার জানিয়েছেন, গত বছরের ৩ নভেম্বর আমতলীর গুলিশাখালী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া গ্রামের ধানক্ষেত থেকে ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় এজাহারভুক্ত কোন আসামি না থাকলেও গত সোমবার (২৩ মার্চ) রাতে সন্দেহভাজন হিসেবে শানু হাওলাদারকে আটক করে পুলিশ। রাতে ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রীর কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়। আবুল বাশার দাবি করেছেন, রাতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু “ক্লু” পাওয়া যায়। থানার সেন্ট্রি ২৬ মার্চ সকালে শানুকে বাথরুমে নিয়ে যায়। তাদের দাবি, বাথরুম থেকে ফিরে এসে শানু দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
নিহত শানু হাওলাদার আমতলীর কলাগাছিয়া গ্রামের হযরত আলী হাওলাদারের ছেলে।
আমতলীর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শংকর প্রসাদ অধিকারী জানিয়েছেন, শানুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
শানু ছেলে সাকিব হাওলাদার জানিয়েছেন, পুলিশ তাদের কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করেছিলো। তারা ১০ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছেন।
শানুর স্ত্রী ঝর্না বেগম জানিয়েছেন, টাকা দিতে না পারায় পুলিশ তার স্বামীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
ঝরনা বেগম বলেন, ‘সোমবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই পরিদর্শক (তদন্ত) আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যান। কী কারণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওসি আবুল বাশার স্যার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যেতে বলেছেন। এরপর মঙ্গলবার একবার আমার ছেলে দেখা করতে পারলেও পরদিন তার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ’স্বামীকে ছাড়াতে হলে তিন লাখ টাকা দাবি করেন মনোরঞ্জন মিস্ত্রি। কিন্তু আমরা ১০ হাজার টাকা জোগাড় করে তাদের হাতে দিই। পুরো টাকা দিতে না পারায় আমার স্বামীকে ওরা নির্যাতন করে হত্যা করেছে।’
মুই টাকা দেতে রাজি অই নাই হেইয়্যার লইগ্যা মোর স্বামীকে পুলিশে পিডাইয়্যা মাইরা হালাইছে
আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার বলেন, ’তিনি একটি হত্যা মামলার আসামি, তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। একপর্যায়ে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তার রুমে গিয়ে আত্মহত্যা করেন।’
যে হত্যা মামলায় তাকে আসামি বলা হচ্ছে, সেই মামলার এজাহারে তার নাম নেই; তাহলে কী করে তিনি আসামি হলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, ’তদন্তে তিনি আসামি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।’ এ সময় ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তদন্ত কর্মকর্তার রুমের পাশেই পুলিশের আরও একটি কক্ষ রয়েছে, যেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ অবস্থান করে। তাছাড়া তার অপর পাশে রয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুম। এরমধ্যে একজন মানুষ কীভাবে রশি নিয়ে এসে আত্মহত্যা করেছে এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর বরগুনা জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা কাদের বলেন, ’আমতলী থানা হাজতের মধ্যে একজনের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে জনমনে বেশ কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, তাকে কেন গ্রেফতারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়নি? দ্বিতীয়ত, তার আত্মহত্যা করার যৌক্তিকতা কতটুকু? তৃতীয়ত, তিনি আত্মহত্যা করার উপকরণ কোথায় পেলেন এবং কীভাবে আত্মহত্যা করলেন? পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব বিষয় দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। কেননা, একজন আসামিকে গ্রেফতারের পর তার হাজতখানায় থাকার কথা, তিনি কী করে তদন্ত কর্মকর্তার রুমে গেলেন?’
সুজনের এই নেতা আরও বলেন, ’তিনি আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বের করা হোক। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ’থানার মধ্যে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে নিরাপত্তা পাবে? আবার পরিবারের দাবি ঘুষ না দেওয়ায় তাকে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা ভীতসন্ত্রস্ত। যদি এমনটিই ঘটে যে তাকে থানা হাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে, তবে তা হবে আইনের চরম লঙ্গন
নিহত শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, আমার বাবাকে ধরে এনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছেন ওসি। মঙ্গলবার দুপুরে আমি ওসিকে ১০ হাজার টাকা দেই। কিন্তু ১০ হাজার টাকায় ওসি তুষ্ট হয়নি। টাকার জন্য নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বারবার আমার কাছে ঘুষের টাকা দাবি করেন।
তিনি আরও বলেন, বুধবার সকালে আমি বাবার সাথে দেখা করতে থানায় গেলে তারা আমাকে দেখা করতে দেয়নি। এ সময় ওসি বলেন, টাকা নিয়ে আস তারপর দেখা করতে দেব।
আমতলী উপজেলা গুলিশালালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মো. নুরুল ইসলাম ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান জানান, শানু হাওলাদারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের সাজানো।
আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, “পুলিশ পরিকল্পিতভাবে শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করছি।”
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন-পিপিএম জানিয়েছেন, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসপি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) তোফায়েল আহম্মেদকে প্রধান করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম ও সহকারী পুলিশ সুপার রবিউল ইসলামকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন