বাংলাদেশের বেসরকারি চাকরির বাজারে লাখ লাখ অবৈধ ভারতীয় নাগরিক !

50

* পোশাক শিল্প, আইটি, ট্রাভেল এজেন্টে আধিপত্য
*  বেশিরভাগই এসেছেন ট্যুরিস্ট ভিসায়

* অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না:স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

 

মিরর বাংলাদেশ :  বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে অবৈধভাবে কাজ করছে ভারতীয় নাগরিকরা। বিশেষ করে পোশাক শিল্পে, আইটি ট্রাভেল এজেন্টে এদের আধিপত্য বেশি। দেশের চাকরিবাজরে ভারতীয় নাগরিকদের দখল নিয়ে আলোচনা বেশ পুরোনো। তবে  রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেস্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এক বক্তব্যে নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
স্বরাষ্ট্র উপদেস্টা বলেছেন,অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। কোনো বিদেশিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকতে দেয়া হবে না। এটি হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নয়। কতজন বিদেশি আছেন, কোন কোন দেশের বিদেশিরা আছেন সেই তালিকা পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তারা কত দিন পর্যন্ত এ দেশে থাকতে পারবেন।
এর আগে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়সে ভেলের ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ভারতীয়দের দাপট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় বিভিন্ন খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বেশিরভাগই আসেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করছেন। এদের বেতন ডলারে ভারতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের কারণে বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে ভারতীয়দের দাপট বেশি। ট্রাভেল এজেন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। পোশাক খাতের টেকনিশিয়ান ও ডিজাইনার কাজে ভারতীয় বেশি। এমনকি সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি, একাউন্টেন্ট, প্রশাসনিক খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। ভারতের পরেই শ্রীলঙ্কা, চীন ও থাইল্যান্ডের অবস্থান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে মোট বিদেশি ২ লাখ ৫০ হাজার। তাদের মধ্যে বৈধ ৯০ হাজার। বাকিরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আছেন। আর যারা বৈধভাবে আছেন তাদের মধ্যে ৫০ ভাগ কোনো অনুমতি না নিয়েই টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। এই বিদেশিরা বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেন।
ডয়সে ভেলে’র প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয় নানা কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাতে ভারতীয়দের অবস্থান শক্ত। করোনাভাইরাসের কারণে চীনাদের দাপট কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় ভারতীয়দের দাপট বাংলাদেশে আরো বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের আইটি খাতের একজন উদ্যোক্তা জানান, সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ভারতীয় কৌশল ব্যবহারের কারণে ওই দেশের জনশক্তিকেও (ভারতীয়) কাজ দিতে হয়। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে তাদের লোক রাখার শর্তজুড়ে দেয়া হয়। আবার ট্রাভেল এজেন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের সফটওয়্যার ও তাদের লোক বলে কাজ হয়। এটা সরকারের পলিসির বিষয়। সরকার পলিসি ঠিক করলে তাদের দাপট কমবে।
বাংলাদেশের চাকরির বাজার নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো বিডিজবস ডটকম। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়রাই শীর্ষে। তারপরে শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড। এদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগেরও ওয়ার্ক পারমিট নেই। অধিকাংশই অবৈধভাবে কাজ করেন। তাদের পেমেন্টও এখানে করা হয়না। ভারতীয় হলে তার পেমেন্ট ভারতেই দেয়া হয়। যারা নিয়োগ করেন তারা এরকম একটা সিস্টেম গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ থেকে কত রেমিট্যান্স দেশের বাইরে যায় সেই হিসাবটি দেখলে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতেই বেশি রেমিট্যান্স যায়। পোশাক খাতের আয়েরও বড় একটি অংশ ভারতীয় টেকনিশিয়ান ও ডিজাইনাররা নিয়ে যান।
২০২৩ সালের ২৩ জুন সংসদে ততকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১১৫টি দেশের ২০ হাজার ৯৮৮ জন নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা উন্নয়ন প্রকল্প, শিল্পকারখানা, এনজিও, আইএনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত বলে জানান তিনি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭৫ জন চীনা, ৫ হাজার ৮৭৬ ভারতীয়, ২ হাজার ৪৬৮ রাশিয়ার, ১ হাজার ২৪৬ শ্রীলংকার, ৯২৪ দক্ষিণ কোরিয়ার, ৫৫৭ জাপানি, ৪১৬ পাকিস্তানি, ৪৬০ ফিলিপিনো, ৩৯৯ থাইল্যান্ডের, ৩৭৮ বেলারুশ, ২৬৯ কাজাখস্তানের, ১৬৮ আমেরিকান, ১৩৯ কোরিয়ার, ১২৩ মালায়েশিয়ার, ১০৮ ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক রয়েছেন। তাঁরা ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত বলে জানান ।
ডয়সে ভেলের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে দু’টি তৈরি পোশাক কারখানার মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে নানা কারণে পোশাক খাতে ভারতীয়দের অবস্থান শক্ত। এর মধ্যে পোশাক খাতে ডিজাইনসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে। আর পোশাকের বায়িং হাউজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। ফলে পোশাক কারাখানাগুলো বায়ার পেতে তাদের কারখানায় মার্কেটিং এবং হিসাব বিভাগেও ভারতীয়দের নিয়োগ করে। তাদের মতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এক লাখেরও বেশি ভারতীয় কাজ করেন। অন্যদিকে বায়িং হাউজে এই সংখ্যা আরো আরো বেশি।
এর বাইরে আইটি খাতেও ভারতীয়দের দাপট। আরো অনেক সেবা খাত আছে যেখানে ভারতীয়রা কাজ করেন। এমনকি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি এসব খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে কম করে হলেও পাঁচ লাখ ভারতীয় কাজ করে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই কোনো ওয়ার্ক পারমিট নেই। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন। আর তাদের বেতন অনেক বেশি। ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা কাজ করেন তাদের রোজগারের পুরো অর্থই অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে যায়।
বাংলাদেশের আইটি খাতের একজন উদ্যোক্তা জানান, ‘সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ভারতীয় কৌশল ব্যবহারের কারণে ওই দেশের জনশক্তিকেও কাজ দিতে হয়। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের লোক রাখার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। আবার ট্রাভেল এজন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের সফটওয়্যার ও তাদের লোক বলে কাজ হয়। এটা সরকারের পলিসির বিষয়। সরকার পলিসি ঠিক করলে তাদের দাপট কমবে ।
দেশে লাখ লাখ শিক্ষিক বেকার থাকা সত্ত্বেও লাখ লাখ ভারতীয় জনবল বাংলাদেশে কাজ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। একটি গনমাধ্যমেকে এর আগে তিনি বলেছিলেন, লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। এত বেকার থাকার পরও বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে কাজ করছে ভারতের কয়েক লাখ মানুষ। তারা এ দেশের শ্রমবাজার দখল করে রেখেছে। নিয়োগদাতারা বাংলাদেশের শিক্ষিতদের সার্টিফিকেট গ্রহণ করছে না। দেশে এত শিক্ষিত বেকার! ভারতের লাখ লাখ জনবল এসে কাজ করছে কীভাবে? এটি তো রীতিমতো ভাবনার বিষয়।’
বিগত সরকারের আমলে যে কোনো সেক্টরে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ছিল একছত্র আধিপত্য। এর ব্যতিক্রম হয়নি টেলিযোগাযোগ শিল্পেও। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মোবাইল অপারেটর তাদের নেটওয়ার্ক ম্যানেজের পুরো কাজটি করছেন ভারতীয় প্রতিষ্ঠান উইপ্রো। সেই ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান উইপ্রো বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত বাংলাদেশি অনেক কর্মচারী তা নিশ্চিত করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা শাহরিয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত কর্মীদের দ্বারা সম্পন্ন করা কাজ, বিদেশি একটি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পর দেশে স্বাভাবিক ভাবে এই শিল্পে তরুণদের কর্মসংস্থানের হার সংকুচিত হয়ে পড়ে।
উইপ্রো দায়িত্ব নেয়ার পর শুরুতে তারা কয়েক ডজন ভারতীয় কর্মী নিয়োগ প্রদান করে, ফলে দেশের তরুণরা তখন থেকেই বঞ্চিত হওয়া শুরু করে। বিদেশি কর্মীরা কাজ শুরু করার পর স্বভাবতই কাজের প্রয়োজনে তাদেরকে বিভিন্ন টেলিযোগযোগ সিস্টেমে এক্সেস প্রদান করা হয়। দেশীয় কর্মীদের আপত্তি উপেক্ষা করে এ কাজ করা হয়। অরক্ষিত হয়ে পড়ে দেশের বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ও ডাটা সিকিউরিটি।