ছবি : জাতির উদ্দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ
* করোনা যুদ্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জয়ী হতে হবে * রফতানি শিল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রনোদনা
মিরর বাংলাদেশ : বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলাকে যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ভাইরাস মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলা একটি যুদ্ধ। সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবোই। এই যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। সকলের প্রচেষ্টায় আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবো ইনশাল্লাহ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বীরের জাতি। ১৯৭১ সালে আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শত্রæকে মোকাবিলা করে যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলাম। এবারও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে হবে। যার যার জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তের জন্য প্রয়োজনীয় কিটের পর্যাপ্ত মজুত আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মজুতও পর্যাপ্ত বলে জানিয়েছেন তিনি।
চিকিৎসকদের ভূমিকা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুত আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গতকাল পর্যন্ত ১৩ হাজার পরীক্ষা কিট মজুদ ছিল। আরও ৩০ হাজার কিট শিগগিরই দেশে পৌঁছাবে। ঢাকায় আটটি পরীক্ষার যন্ত্র রয়েছে। দেশের অন্য সাতটি বিভাগেও করোনাভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলছে।
স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রশাসনের সদস্যদের এই ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে একযোগে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন বেতার-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে কেউ গুজব ছড়াবেন না। গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৯ মার্চ থেকে বিদেশ থেকে আসা সব যাত্রীর সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে ঢাকায় আশকোনা হাজী ক্যাম্প ও টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান কোয়ারেনটাইন সেন্টার হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দিয়েছি। বিদেশে অবস্থিত আমাদের মিশনগুলোকে কোনো বিদেশি নাগরিককে ভিসা না দিতে বলা হয়েছে। বিদেশ থেকে যারা আসছেন তাদের তালিকা ঠিকানাসহ জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন আগত প্রবাসীদের হোম কোয়ারেনটাইনে রাখার ব্যবস্থা করছেন।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এছাড়া সোসাইটি অব ডক্টরস তাদের ৫০০টি নম্বর উন্মুক্ত করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ওই সব নম্বরে যোগাযোগ করুন। সরকার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস দ্রæত ছড়ানোর ক্ষমতা রাখলেও ততটা প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত সিংহভাগ মানুষই কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে, আগে থেকেই নানা রোগে আক্রান্ত ও বয়স্ক মানুষদের জন্য এই ভাইরাস বেশ প্রাণ-সংহারী হয়ে উঠেছে। সে জন্য আপনার পরিবারের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষটির প্রতি বেশি নজর দিন। তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করুন। তাকে ভাইরাসমুক্ত রাখার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিন।
আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আতঙ্ক মানুষের যৌক্তিক চিন্তাভাবনার বিলোপ ঘটায়। সবসময় খেয়াল রাখুন, আপনি ও আপনার পরিবারের সদস্য এবং আপনার প্রতিবেশীরা যেন সংক্রমিত না হন। আপনার সচেতনতা আপনাকে, আপনার পরিবারকে ও সর্বোপরি দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখবে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ নাগরিকের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ভাইরাস আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এই আভাস দিয়েছেন। বাংলাদেশেও এই ভাইরাস দেখা দিয়েছে। কিন্তু কেউ উৎকণ্ঠিত হবেন না। আপনাদের স্বজন যারা বিদেশে আছেন, আপনাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি।’
শেখ হাসিনা এ সময় আহ্বান জানান, সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সংযমের মাধ্যমে এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে হবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আপনাদের কাছে অনুরোধ হোম কোয়ারেনটাইনসহ যে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। মাত্র ১৪ দিন ঘরে থাকুন। অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘খেয়াল রাখুন, আপনার কারণে যেন প্রতিবেশী সংক্রমিত না হোন। এছাড়া পরিবারের সংবেদনশীল মানুষটির দিকে খেয়াল রাখুন। তাকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় যতœ নিন।’
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের বিস্তারের এই সময়ে সবাইকে সহনশীল ও সংবেদনশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য মজুত আছে উল্লেখ করে বাড়তি পণ্য না কেনারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুগে যুগে জাতীয় জীবনে নানা সংকটময় মুহূর্ত এসেছে। জনগণের সম্মিলিত শক্তির বলেই সেসব দুর্যোগ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেয়েছে। এর আগে প্লেগ, গুটি বসন্ত, কলেরার মতো মহামারি মানুষ প্রতিরোধ করেছে।
তিনি বলেন, ওই সব মহামারির সময় বিশ্ব এখনকার ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল না। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ তখন একদেশ থেকে অন্য দেশে বা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করত না। এ কারণে করোনাভাইরাস দ্রæততম সময়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিরও অনেক উন্নতি হয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই বিশ্ববাসী এ দুর্যোগ থেকে দ্রæত পরিত্রাণ পাবে।
করোনাভাইরাস সংকটের সময় সবাইকে সংবেদনশীল থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরের সঙ্গে সরবরাহ চেইন অটুট রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়াবেন না। জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। সর্বত্র বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বর্তমানে করোনাভাইরাস ঘিরে গোটা বিশ্বই অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিয়ে চলছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তবে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের সরকার প্রস্তুত রয়েছে। আমরা জনগণের সরকার। সবসময়ই আমরা জনগণের পাশে আছি। আমি নিজে সব্সময় পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।
বাড়তি পণ্য কেনা বা পণ্য মজুত না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এখন কৃচ্ছতা সাধানের সময়। যতটুকু না হলে নয়, তার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। মজুত করবেন না। সীমিত আয়ের মানুষকে কেনার সুযোগ দিন।
তিনি বলেন, আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি মিল মালিকদের কাছে এবং কৃষকদের ঘরে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত আছে। চলতি মৌসুমে আলু-পেঁয়াজ-মরিচ-গমের বাম্পার ফলন হয়েছে।
আরও বেশি চাষাবাদে উৎসাহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, কৃষক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, কোনো জমি ফেলে রাখবেন না। আরও বেশি বেশি ফসল ফলান।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫ হাজার টাকার কোটি টাকার প্রণোদোনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্যই কেবল এই অর্থ ব্যবহার করা যাবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিল্প উৎপাদন ও রফতানি বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই আঘাত মোকাবিলায় আমরা কিছু আপৎকালীন ব্যবস্থা নিয়েছি। রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দিয়ে কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও কিছু উদ্যোগ এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যবসায়-বান্ধব বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী জুন মাস পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ঋণ খেলাপি না করার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, রফতানি আয় আদায়ের সময়সীমা দুই মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি ব্যয় মেটানোর সময়সীমা চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। মোবাইলে ব্যাংকিংয়ে আর্থিক লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল পরিশোধের সময়সীমা সারচার্জ বা জরিমানা ছাড়া জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এনজিওগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
সবার সম্মিলিত প্রয়াসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধেও আমরা সফল হব বলে ভাষণে আশাবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।