বিচারপতি খায়রুল হকের রায় জালিয়াতির প্রথম মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি

186

মিরর বাংলাদেশ :
সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে জালজালিয়াতি করে রায় প্রদান ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে প্রথম মামলাটি হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায়। এছাড়া বিচারপতি খায়রুলেরর বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা হয় নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায়। ফতুল্লা থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডি থানা এলাকা থেকে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেফতারের পর মামলাগুলোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আসে।
খায়রুল হকের গ্রেফতারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রথম মামলার বাদী এডভোকেট আবদুল বারী ভূঁইয়া। তিনি নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। খায়রুল হকের গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া বৃহস্পতিবার দৃুপুরে  জানান, খায়রুল হক গ্রেফতার হয়েছে ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আরো অনেক আগেই তাকে গ্রেফতার করা দরকার ছিল। তিনি দেশে সকল অশান্তির কারিগর। খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করার অন্যতম উদ্যেক্তা। তত্ববধায়ক সরকার প্রক্রিয় তিনি বাতিল করেছেন। এর মাধ্যম বিগত দিনে যত ধরনের অপরাধ হয়েছে তার দায় খায়রুল হকের উপর বর্তায়। তিনি বলেন, আমার দায়ের করা মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছেন। খায়রুল হক গ্রেফতারের পর সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন। এবং পরবতী পদক্ষেপ কি নিবেন সেটাও আমাকে জানাবেন বলেছেন।
ফতুল্লা থানার ওসি শরিফুল ইসলাম জানান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি পুলিশের সিআইডি বিভাগ তদন্ত করছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ১৮ আগষ্ট সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় পরিবর্তনের জন্য প্রতারণা, জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সদ্য আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করলে ঐ আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হকের আদালতে এ মামলা করেন অ্যাডভোকেট ইমরুল হাসান। মামলার গ্রহণযোগ্য উপাদান না থাকায় আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।এর পর গত ২৫ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবদুল বারী ভূঁইয়া ফতুল্লা থানায় সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। বেআইনি রায় প্রদান ও জাল রায় তৈরি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের অভিযোগে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে এমামলা দায়ের হয়।
মামলার এজহারে বলা হয়, এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর শুনানিকালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতিমান ৮ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিযুক্ত করা হয়। এরা হলেন সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির, অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনুদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হক। একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হক ছাড়া সবাই তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মতামত দেন।
এজহারে আরও বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক, বিচারপতি এস.কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। আর বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি ঈমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। এ বিষয়টি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আগেই বুঝতে পেরে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তত্ত্বাবধায়ক চার্জ সরকার বাতিলের পক্ষে কাস্টিং ভোট প্রদান করেন। ফলে চার-তিনে মেজরিটি হয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তত্ত্ববধায়ক সরকার বাতিলের রায় হয়।
এজহারে আরও বলা হয়, প্রকাশ্য আদালতে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এই সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে সংবিধান থেকে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ২০১১ সালের ১০ মে চেম্বারে বসিয়া বেলা ২টায় আমি এই সংবাদ পাই। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় সর্বসম্মত ছিল না। রায় প্রদানের পরপরই সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে চলে যান। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পরে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস ও জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তিদের পরামর্শ ও ইন্ধনে এক রায় লিখে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে জমা দেন।
এজহারে আরও বলা হয়, রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তঞ্চকতা, জাল জালিয়াতি ও রাষ্ট্রদ্রোহ/ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংসের অভিপ্রায়ে পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে হইতে পারে মর্মে (প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে) কথাটি বাদ দেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পরে প্রকাশ্য আদালতে দেওয়া রায়টি পরিবর্তন করে বিশ্বাস ভঙ্গ, তঞ্চকতা, জাল- জালিয়াতিপূর্ণ, রাষ্ট্রদ্রোহ/রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংসের ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।
এদিকে গত বছরের ২৬ আগষ্ট রাতে নুরুল ইসলাম মোল্লা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা দায়ের করেন । মামলায় বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণা ও জালজালিয়াতি করে রায় দেওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার বাদী নুরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার মদনপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
জানা গেছে, বিচারপতি খায়রুল হক অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য অভিযুক্ত আমলে না নিয়ে তার চাকরি মেয়াদকালে তড়িঘড়ি করে ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় প্রদান করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু রায়ের ব্যাপারে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়ায় তিনি আর স্বাক্ষর প্রদান করেন নাই এবং নথি নিজ জিম্মায় বাসায় নিয়ে রাখেন।
বিগত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে চিরকাল ক্ষমতায় রাখার জন্য রায় এর ১৬ মাস ৩ দিন পর পরে ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায়ে করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৬ মাস ৩ দিন পর যে রায় প্রকাশ করলেন সেখানে তিনি এ অংশটি রাখেননি।
এবিএম খায়রুল হক তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান কর্তৃক বিগত ২০১০ সালের ১ অক্টোবর নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।