মিরর বাংলাদেশ : দেশে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের (পিপিই) সংকটের মধ্যেই এখন পর্যন্ত তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। তবে বিপত্তি ঘটছে লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের নিয়ে। অনেকে তথ্য গোপন করে হাসপাতালে যাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। আর সরকারি হাসপাতালগুলো চালু থাকলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। ফলে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম।
কভিড-১৯ উপসর্গ গোপন করে গত বুধবার রাজধানীর শ্যামলীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে চিকিৎসা নিতে আসেন এক বৃদ্ধ। দুদিন চিকিৎসার পর পরীক্ষায় তার শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্তত ১৩ স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে, যার মধ্যে একজন এরই মধ্যে জ্বরাক্রান্ত।
বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এ রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু পরীক্ষার অপ্রতুলতার কারণেও আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হওয়ায় চিকিৎসাসেবা নিতে বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ। ফলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্যদেরও সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করছেন এসব রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই চিকিৎসকদের সেবা দিতে হচ্ছে। রয়েছে পিপিইর সংকট। একই পিপিই একাধিক চিকিৎসককে ব্যবহার করতে হচ্ছে। সরবরাহ করা হয়নি এন৯৫ বা সমমানের কোনো মাস্ক। অথচ বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসকরাও ব্যাপক হারে সংক্রমিত হচ্ছেন নভেল করোনাভাইরাসে।
দেশে এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যসেবাসংশ্লিষ্ট কতজন এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়ের কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) নামে চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে গতকাল পর্যন্ত ১০২ জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত বুধবার। আবার একজন চিকিৎসকের সুস্থ হয়ে ওঠারও খবর মিলেছে।
চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির হিসাবে, এরই মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ৫৭ জন নার্সের শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। কোয়ারেন্টিনে আছেন আরো প্রায় ২৭০ জন নার্স। আর গত শুক্রবার পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এমন হাসপাতালের সংখ্যা সারা দেশে ২৪টি। এর মধ্যে সারা দেশে ১৪টি সরকারি হাসপাতাল ও রাজধানী ঢাকার ১০টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হসপিটাল (এ্যাপোলো হসপিটাল), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ধানমন্ডির ইবনে সিনা হসপিটাল, আজগর আলী হসপিটাল, মিরপুরের ডেল্টা হসপিটাল, মগবাজারের ইনসাফ বারাকা হাসপাতাল, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইমপালস্ হাসপাতাল এবং গাজীপুরের কেপিজে হাসপাতাল।
উপসর্গ গোপন করে আসা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধও হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল প্রথম রাজধানীর মগবাজারের ইনসাফ বারাকা কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের দুজন নার্সের শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরে চিকিৎসকসহ সর্বমোট ৬২ জনের করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই পরীক্ষা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ)। পরীক্ষায় দুজন চিকিৎসকসহ ১৩ জনের করোনাভাইরাস পজিটিভ এলে বেসরকারি এই হাসপাতালটি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
ইনসাফ বারাকা কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ডিএমডি আলতাব হোসেন জানান, একজন নার্সের জ্বর আসার পর তাকে প্রথমে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা করা হয়। করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের এখন কোনো উপসর্গ নেই। সবাই সুস্থ আছেন। বর্তমানে তারা ইনসাফ বারাকা কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালেই অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
একই দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের একটি সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট) বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হার্টের সমস্যার কথা জানিয়ে ১৩ এপ্রিল এক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। কভিড-১৯ সংক্রমণের বিষয়টি গোপন করলেও পরবর্তী সময়ে তা জানাজানি হলে হাসপাতালটির একটি সিসিইউ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া চিকিৎসক ও নার্সদের কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।
১৫ এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালের চার চিকিৎসক ও দুই নার্সের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর দুটি বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। ইমপালস হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার ডাক্তার খাদিজা জুমা চারজন চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গাইনি ও সার্জারি বিভাগ লকডাউন করা হয়েছে।
রোগীরা কভিড-১৯-এর উপসর্গ গোপন করায় শুধু বেসরকারি হাসপাতালগুলোই নয়, করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন দেশের ১৪টি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতাল। এর বাইরে নেত্রকোনার কালিয়াঝুড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহের কালিগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও নরসিংদী ১০০ বেড সদর হাসপাতাল। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে কোনো এন৯৫ মাস্ক দেয়া হয়নি। সার্জিক্যাল মাস্ক যা দেয়া হয়েছে, সেগুলোর সংখ্যাও অপ্রতুল। আবার ডিসপোজেবল পিপিই সরবরাহ করে সেগুলো আবার ধুয়ে ব্যবহার করার জন্য বলা হয়েছে। সেগুলোও সংখ্যায় খুব কম। কিন্তু প্রায়ই কভিড-১৯-এর উপসর্গ গোপন করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সংস্পর্শে যেতে হচ্ছে তাদের। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনজন নার্সের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর পর থেকে অন্য নার্সরাও তাদের কার্যক্রম সীমিত করে এনেছেন।
এদিকে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক, নার্স ও তাদের স্বজনসহ আরো ২৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম সরকার জানান, কভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক, নার্স, অন্য বিভাগের কর্মী ও তাদের স্বজনরা রয়েছেন। আক্রান্ত সবাই আইসোলেশনে রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের গাইডলাইন আছে, একইভাবে হাসপাতাল কীভাবে পরিচালিত হবে তারও গাইডলাইন আছে। গাইডলাইনগুলো লক্ষ করলে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। আর এ বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি, তারও গাইডলাইন আছে। অর্থাৎ কতজন চিকিৎসক রিজার্ভ থাকবে, কতজন ডিউটি করবে—তা বলা আছে। অবশ্যই সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে, চিকিৎসকরা সম্মুখসারিতে আছেন, তাদের যথাযথ সুরক্ষিত থাকতে হবে। তা না হলে তারা দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, এসব বিষয়ে কমিটি আছে। সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত করছি, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুত্র : বনিকবার্তা