মেট্রো রেল: ৩’শ ৩০ কোটি লুটপাটের দূরবীসন্ধি ছিল আওয়ামীলীগের

100

* ২ মাস ২৭ দিনে দেড় কোটি টাকা খরচে চালূ হয়েছে মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া ষ্টেশন

মিরর বাংলাদেশ : বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের শেষ সময় আন্দোলন কালে মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্থ ২টি স্টেশন মেরামত করতে খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা। এজন্য ব্যায়ের একটা প্রাক্কালন তৈরী করেছিল বিদায়ী সরকারের দোসররা। তবে আওয়ামীলীগের বিদায়ের পর ক্ষতিগ্রস্থ মেট্রোরেলের ২টি ষ্টেশন চালু হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে চালু করতে খরচ লেগেছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
মঙ্গলবার চালু হয়েছে মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন চালু এর আগে চালু করা হয় ক্ষতিগ্রস্থ কাজীপাড়া স্টেশন। ক্ষতিগ্রস্থ ষ্টেশন প্রতিস্থাপনের জন্য যেগুলি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলিও পুনরুদ্ধার করতে হলে আরও ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা লাগতে পারে। হিসেবে বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, মেট্রোরেলের এই দুইটি ক্ষতিগ্রস্থ ষ্টেশন মেরামতের নামে প্রায় ৩শ ৩০ কোটি টাকা লুটপাট করতে চেয়েছিল আওয়ামীলীগ। যদি দলটি ক্ষমতায় থেকে যেতো তাহলে এখান থেকে ৩শ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হতো।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন চালু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে এ স্টেশন থেকে যাত্রীরা মেট্রোরেলে ওঠানামা করতে পারছেন। এর আগে, সোমবার ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ২ মাস ১৭ দিন পর মঙ্গলবার সকাল থেকে চালু হচ্ছে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন। স্টেশনটি পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করতে কত ব্যয় হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএল এমডি বলেন, ব্যয় কত হলো, সে প্রশ্ন এখনই করবেন না। এটা আমরা নিরূপণে কাজ করছি।
গত বৃহস্পতিবার এমডি আব্দুর রউফ জানিয়েছিলেন, কাজীপাড়া স্টেশন মেরামতে প্রাথমিকভাবে খরচ হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ স্টেশনের যন্ত্রপাতি মেরামত ও প্রতিস্থাপনে কাজীপাড়ার চেয়ে খরচ বেশি হবে।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। স্টেশনের টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সবকিছু ভাঙচুর করা হয়। এরপরই দীর্ঘ সময়ের জন্য অনিশ্চিত হয়ে যায় মেট্রোরেল চলাচল। ৩৭ দিন বন্ধ থাকার পর গত ২৫ আগস্ট আবার চালু হয় মেট্রোরেল। তবে বন্ধ থাকে মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন। এরও ২৬ দিন পর কাজীপাড়া স্টেশন চালু করা হয়।
এদিকে মেট্রোরেলে যাত্রীরা এককযাত্রার ২ লাখ টিকিট কার্ড নিয়ে চলে গেছেন, যা স্টেশনগুলোতে টিকিট সংকট সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায়, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের কাছে এসব টিকিট ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ এই আহ্বান জানান।
তিনি জানান, মেট্রোরেলের সব স্টেশন মিলিয়ে মোট ২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪১টি এককযাত্রার টিকিট বিতরণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ টিকিট জমা হয়নি, এবং ৬ হাজার ৮৮১টি টিকিট নষ্ট হয়ে গেছে। ১ হাজার ৫০০ কার্ড হারিয়ে গেছে। আবদুর রউফ বলেন, টিকিট বাইরে নিয়ে যাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ, তাই যাত্রীদের কার্ড নিকটবর্তী স্টেশনে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কার্ড হারানোর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পরিবারের একাধিক সদস্যের জন্য টিকিট কাটার সময় অনেকেই একসঙ্গে বের হওয়ার সময় একাধিক টিকিট জমা দিতে ভুলে যান। এই কারণে স্টেশনে টিকিটের অভাব দেখা দেয়।এদিকে, মেট্রোরেলের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি হচ্ছে, যা দিয়ে যাত্রীরা ঘরে বসেই সহজে কার্ড রিচার্জ করতে পারবেন। আবদুর রউফ জানান, অ্যাপটি শিগগিরই চালু হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশন অবশেষে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফৌজুল কবির খানের মতে, স্টেশনটি মেরামত করতে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে মিরপুর-১০ স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে উঠতে পারছেন যাত্রীরা।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্টেশন পরিদর্শন করার সময় উপদেষ্টা বলেন, “অন্যান্য স্টেশনগুলি থেকে কিছু সরঞ্জাম অদলবদল করার পরে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত না করে এটি ঠিক করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের এখানে আরও কিছু সরঞ্জাম দরকার। আমরা প্রতিস্থাপনের জন্য যেগুলি ব্যবহার করেছি সেগুলিও পুনরুদ্ধার করা হবে৷ এর জন্য আমাদের আরও ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা লাগবে। এতে মোট খরচ হবে ১৮ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও বিদেশের মেট্রো বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় স্টেশনগুলো পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে।
মিরপুর-১০ নম্বরের মেট্রোস্টেশন চালু করতে প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। মেট্রোর উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও বিজয় সরণি স্টেশন থেকে যন্ত্রাংশ এনে স্থাপনের পর স্থানীয় বাজার থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনতে এই খরচ হয়েছে। তবে ওই সব স্টেশন থেকে আনা যন্ত্রাংশগুলো দেশের বাইরে থেকে আনার পর পুনরায় স্থাপন করার জন্য আরও ১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। সব মিলে মোট খরচ হবে ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রোস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে এসব তথ্য জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। প্রায় তিন মাস পর সকাল থেকে এই স্টেশন চালু করে দেওয়া হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার মধ্যে গত ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই দিন বিকেল পাঁচটায় মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর পরদিন মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর করা হয়।
গত ২০ জুলাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেছিলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি মেরামত করে পুনরায় চালু করতে এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে।’
গত ২৭ জুলাই তখনকার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না।’
২ মাস ২৭ দিন পর মিরপুর ১০ মেট্রোস্টেশন চালু হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মেট্রোরেল চালু হলো। কাজটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে, তা জানিয়ে ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘মেট্রোরেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোকে সহায়তা করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেখানে দেশের বাইরে মেট্রোরেলে কাজ করেন এমন একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবার সহায়তায় এটা সম্ভব হয়েছে।’
তৎকালীন সরকারের সময় মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনের মেরামতের জন্য সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে কাজীপাড়া স্টেশন মেরামতে ২০ লাখ ২৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন মেরামতে খরচ হচ্ছে পৌনে ১৯ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, ‘এখানে উন্নয়নের বিষয়ে শিক্ষা আছে। বলা হচ্ছে, এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশ হবে। সবাই হতাশ। আগে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতো। হিসাব করলে বুঝতে পারবেন, এখানে ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় করলে আর এক বছর ধরে কাজ করলে জিডিপি বাড়ত। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন হতো না। এখন যে প্রবৃদ্ধির হার, সেগুলো হবে প্রকৃত উন্নয়ন। শুধু অঙ্কের হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সর্বোচ্চ যেখানে ১৮ কোটি টাকা খরচ করা হবে, বাকি টাকা যদি বিদেশে যেত, তখন কী উন্নয়ন হতো?’
দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানকে একে একে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। মেট্রোরই উদাহরণ বলি, যিনি এমডি হবেন, তাঁকে সরকারের সাবেক সচিব হতে হবে। দেশ কি শুধুই সাবেক সচিবদের, নাকি দেশটা সবার। এই নিয়ম বাতিল করা হয়েছে। এখন মেট্রোর এমডি হতে সাবেক সচিব হওয়ার প্রয়োজন নেই। যোগ্য ব্যক্তি হলেই হবে।’
মেট্রোস্টেশন বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা জানতে চাইলে ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এগুলো ছাত্ররা করেনি, অন্য দুষ্কৃতকারীরা করেছে। কিছু সিসিটিভি ফুটেজ আছে। সেগুলো পুলিশপ্রধানকে দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।