মিরর বাংলাদেশ: প্রায় ৩০ বছর আগে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যায় তার ভাসুরসহ চারজনের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যে চার্জশিট দাখিল করেছে, তাতে তুলে ধরা অভিযোগকে মিথ্যা, মনগড়া ও বানোয়াট বলে দাবি করেছে বিবাদীর পরিবার। এমনকি পিবিআইয়ের চার্জশিটে উল্লিখিত কিছু বক্তব্য খণ্ডনও করেছে তারা।
শুক্রবার (১৩ মার্চ) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের তদন্ত কার্যক্রম ও চার্জশিটের ‘নানা অসঙ্গতি’ তুলে ধরেন সগিরার ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনের (৬৪) সন্তান চৌধুরী দিরাবিজ মাহমুদ ও চৌধুরী মাহির আনসার।
গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সগিরার ভাসুর ডা. হাসান ও তার স্ত্রী শাহিনসহ চারজনকে আসামি করে ১ হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পুলিশের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। অন্য আসামিরা হলেন- হাসান আলীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান এবং ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা।
৯ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ পিবিআইয়ের দেয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য ১৫ মার্চ দিন ধার্য করা হয়েছে।
চার্জশিটে পিবিআইয়ের উল্লেখ করা অভিযোগের জবাব দিয়ে চৌধুরী দিরাবিজ মাহমুদ ও চৌধুরী মাহির আনসার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই আমার ছোট চাচি সগিরা মোর্শেদ আমাদের চাচাতো বোন সারাহাত সালমা চৌধুরীকে স্কুল থেকে আনার পথে ছিনতাইকারীদের গুলিতে মারা যান। ওই ঘটনা অনেক নাড়া দিয়েছিল সবাইকে। কিন্তু সে ঘটনায় দায়ের করা মামলা ১৯৯১ সালে হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে যায়, যা গত বছরের জুনে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ নভেম্বর বাবা-মা এবং বড় মামা মারুফ রেজাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয় এবং গত ১৬ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পিবিআই।
দিরাবিজ মাহমুদ ও মাহির আনসার বলেন, ৩০ বছর আগের একটি ঘটনায় নির্দোষ বাবা-মা ও মামাকে ফাঁসাতেই মামলাটি মিথ্যাভাবে সাজানো হয়েছে।
পিবিআই’র চার্জশিটে উল্লিখিত হত্যার কারণসমূহের অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে তারা বলেন, তৃতীয় তলা থেকে ময়লা কিভাবে দ্বিতীয় তলায় যায়? ময়লা তো নিচতলায় পড়ার কথা। নিচতলায় থাকতেন বড় চাচি। তিনি কখনো ময়লা ফেলা নিয়ে আপত্তি জানাননি। দ্বিতীয়ত; শাশুড়ি কর্তৃক সগিরা মোর্শেদকে অধিকতর পছন্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। আমাদের দাদি নিচতলায় বড় চাচার বাসায় থাকতেন বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে। ছোট চাচা-চাচি তো বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ৫ বছর বাইরেই ছিলেন। আসার পর ১-২ বছরের দাদিকে পেয়েছিলেন। দাদি বেঁচে থাকার সময় তো ছোট চাচি চাকরি করেননি, তাহলে হিংসা কীভাবে হয়? তৃতীয়ত; শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ইগো সৃষ্টির অভিযোগটিও ভুয়া। কারণ ছোট চাচি মাস্টার্স পাস, আমাদের আম্মা অনার্স পাস ও বড় চাচি এসএসসি পাস। ১৯৮০ সালে আব্বা ও আম্মার বিয়ের আগে আমাদের ছোট চাচা ও ছোট চাচির বিয়ে হয় এবং ছোট চাচা ১৯৮০ সালে ইরাকে যাওয়ার পর ছোট চাচি কোনো চাকরি করেননি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। ৩ জা যদি গৃহিনী হয়ে থাকেন, তাহলে ইগো কীভাবে আসে? চতুর্থত; আব্বা বাসার পেছনে বাড়ির কাজ শুরু করেন ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে। ছোট চাচি মারা যাওয়ার সময় ২-৩ তলা হয়েছিল। ছোট চাচা বাড়ির কাজ শুরু করেন ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দুইটা নির্মাণাধীন বাসা দেখে কীভাবে কার হিংসা হয়? পঞ্চমত; বড় ও ছোট চাচি আম্মার থেকে বয়সে তিন বছরের বড়। তাই উভয়ে উভয়কেই তুমি করে ডাকতেন। তুমি বলে সম্মোধন নিয়ে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্যের অভিযোগও মিথ্যে। আর শুধু তৃতীয় তলার ছাদ ব্যবহার নিয়ে মনোমালিন্যে কেউ কাউকে হত্যা করতে পারে সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সপ্তমত; কাজের মেয়ে জাহানুরকে মারধর ও ‘তোমাকে দেখে নিব বলে হুমকি’র বিষয়টি পুরো সত্য নয়। কাজের মেয়ে জাহানুরকে নিয়েই যদি ঘটনার সূত্রপাত হয়, তাহলে সেই কাজের মেয়ের কোনো বক্তব্য পিবিআই নেয়নি কেন?
এছাড়া চার্জশিটে লেখা, ঘটনার দিন দুপুর ২টায় আব্বা ফোন দিয়ে মামা আনাসকে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে মৌচাকে থাকতে বলেন। আর বাদী আনুমানিক বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে ছোট চাচিকে বলেন যে, ‘আমি যাবো না, তুমি যাও’ এবং রিকশাতে ওঠার কিছুক্ষণ পরে ছোট চাচি বলেন, মৌচাক দিয়ে স্কুলে যেতে। তাহলে আব্বা দুপুর ২টার সময় কীভাবে জানলেন যে ছোট চাচি না চাচা স্কুলে যাচ্ছেন? আর মামা ওই বছরের শুরু থেকে এইচসিএল কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং জুন-জুলাই মাসে প্রজেক্টের কাজে রংপুরে পোস্টিং ছিল তার।
দিরাবিজ মাহমুদ ও মাহির আনসার বলেন, একটি চিরকুটের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। কিন্তু সেটি কোথায়? ৩০ বছর আগে আদালতের জবানবন্দিতে ছোট চাচা বলতে পারেননি, কোন জিডিও করেননি। আম্মার ৪০ বছর আগের চিঠি সযত্নে রাখতে পারলে চিরকুট কেন পারেননি? বাদী যদি পরিবারের কথা শুনে তখন কেস নিয়ে না এগিয়ে থাকেন এবং ৩০ বছর যাবত সত্য গোপন রাখেন, তাহলে আসল খুনি কে?
মাহির আনসার বলেন, ৩০ বছর আগে রিকশাওয়ালা আসামি মন্টুকে চিনতে পারেনি, শুধু গোঁফ থাকার কারণে। সেই একই রিকশাওয়ালা পিবিআই’র স্কেচ করা মারুফ রেজার ছবি দেখে এক বাক্যে চতুর্থ আসামিকে চিনে ফেললো, ১৯৮৯ সালে যার বয়স ছিল ১৮ বছর। এটা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া পিবিআই শুধু বড় চাচা ও বড় চাচির বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসে। ছোট চাচার শ্বশুর বাড়ি, বড় চাচা-চাচি এবং বড় চাচার শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে কেন পিবিআই অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি? যেখানে আমাদের ৮৪ বছর বয়সী নানুকেও পিবিআই অফিসে যেতে চিঠি দেয়া হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পিবিআই মামলার দায়িত্ব নিয়েছে গত বছরের ১৭ জুলাই এবং বাদী মাত্র ৮ দিনে ২৫ জুলাই ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। বাদী মিথ্যা ও বানায়াট ঘটনার তথ্য ৮ দিনের মধ্যে পিবিআইতে দাখিল করেন, যার মাধ্যমে পিবিআই’র সম্মানকে ও ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
দিরাবিজ মাহমুদ ও মাহির আনসার বলেন, এসব কারণে আমাদের ও আত্মীয়দের মনে সন্দেহের উদ্রেক তৈরি হওয়ায় আমাদের মনে হচ্ছে যে, আসল খুনি অন্য কেউ। সেটা বাদী, নাকি তার শ্বশুর বাড়ির কেউ, নাকি অন্য কেউ সেটা বের করার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, ঘটনাটি পুনরায় সুষ্ঠভাবে তদন্ত করে আসল খুনি বের করা হোক।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ওই হত্যাকাণ্ডে রমনা থানায় মামলা করেন সগিরার স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী। পরে মিন্টু ওরফে মন্টু ওরফে মরণের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দীক। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় সাতজনের। সাক্ষীতে মারুফ রেজা নামে এক ব্যক্তির নাম আসায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই বছরের ২৩ মে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা (১০৪২/১৯৯১) করেন মারুফ রেজা, যিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়।
১৯৯১ সালের ২ জুলাই ওই তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ১৯৯২ সালের ২৭ আগস্ট ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে মর্মে আরেকটি আদেশ দেয়া হয়।
২০১৯ সালের ২৬ জুন এ মামলার ওপর ২৮ বছর ধরে থাকা স্থগিতাদেশ তুলে নেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মামলা ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) অধিকতর তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দেন। পরে তাদের আরও ৬০ দিনের সময় দেন আদালত। এরপর পিবিআই অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করে।