ছবিটি যাত্রাবাড়ি মাছ ও কাঁচামালের বাজার
খাদিজা পারভীন উপমা : লকডাউন না মেনে সবধরনের বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাতো দুরে থাক বরং বাজারে হুমড়িখেয়ে পড়ছে মানুষ।
জানা যায়, পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় তুলনামূলক কমে এসেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। সেই সুযোগে রাজধানীর সব ধরনের বাজারে বেড়েছে লোকসমাগম। এছাড়া জেলা উপজেলার বাজারগুলোর চিত্র একই।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বাজারগুলোতে কেবল মুদি বা সবজির দোকান খোলা থাকার কথা থাকলেও শাটার নামিয়ে চা-সিগারেটের দোকানেও বসছে আড্ডা। রাজধানীর বেশ কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে শুক্রবার এমন দৃশ্য দেখা যায়। এ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংকটকালীন স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর আনুপাতিক সংখ্যা বিবেচনায় রাজধানীতে ওয়ারীর পরই মোহাম্মদপুরের স্থান। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকাটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাজার। এসব বাজারের মধ্যে অন্যতম কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার ও নবোদয় বাজার।
গতকাল শুক্রবারও নবোদয় বাজারে ব্যাপক লোকসমাগমের চিত্র দেখা যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বাজারটিকে একমুখী করে দেয়া হলেও মানা হচ্ছে না সেই নিয়ম। যদিও এ বাজারের ৫০ ফুটের মধ্যে চারজনের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, নবোদয় বাজারের পাশেই একই পরিবারের চারজনের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ১১ এপ্রিল বাজারটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বৃদ্ধি করা হয় বাজারকেন্দ্রিক পুলিশের উপস্থিতিও। তবে এর দুই দিন পর থেকেই অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল থেকে সেখানে পুলিশের উপস্থিতি কমে আসে। ধীরে ধীরে আগের ব্যস্ত রূপে ফিরতে শুরু করে বাজারটি। এখন সারা দিনে এক থেকে দুবারের বেশি পুলিশের দেখা না মেলায় আগের মতোই গায়ে গা ঘেঁষে চলছে বাজারের কার্যক্রম। এমনকি এ বাজারের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা চা-সিগারেটের দোকানগুলোতে শাটার নামিয়ে ভেতরে বসছে আড্ডা।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চিত্রও একই রকম। দুই অংশে বিভক্ত এ বাজারটিতেও লোকসমাগম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েক গুণ বেড়েছে। তবে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে লোকসমাগম কিছুটা কম দেখা গিয়েছে গতকাল।
১০ জনের বেশি কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ায় রাজধানীর ধানমন্ডিকেও রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এলাকাটিতে চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। প্রথমদিকে এ বিধিনিষেধ কার্যকর থাকলেও বর্তমানে পশ্চিম ধানমন্ডির বেশ কয়েকটি এলাকায় এখন আর তা মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ পশ্চিম ধানমন্ডির মধুবাজারে গায়ে গা ঘেঁষে চলছে কেনাবেচা। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধুবাজারের বাসিন্দাদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও সেই বাজারে ভিড় করছেন।
রাজধানীর অন্যতম কর্মব্যস্ত এলাকা তেজগাঁও। রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত এ এলাকাটিতে রয়েছে ছোট-বড় শিল্প-কারখানার পাশাপাশি ট্রাক স্ট্যান্ড ও পাইকারি কারওয়ান বাজার। রাজধানীর অন্য বাজারগুলোর তুলনায় এ কারওয়ান বাজারে জনসমাগম কয়েক গুণ বেশি। কারওয়ান বাজারের একাংশে রয়েছে পাইকারি আড়ত, আরেক অংশে রয়েছে খুচরা বিক্রির কেন্দ্র। তাছাড়া প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে করে এ বাজারটিতে আনা হয় কাঁচা শাকসবজি ও মাছ-মাংস। তাই অন্য বাজারগুলোর তুলনায় এখানে নানা শ্রেণীর মানুষের একত্রিত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি থাকে। এরই মধ্যে এ বাজারের দুজন আড়তদারের শরীরে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত পরিচালনা করে আসছেন আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, রাজধানীবাসী এলাকাভিত্তিক বাজারগুলোতে মাছ পাঠাতে হয় তাদের। এজন্য তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে আনলে অন্য বাজারগুলোও মাছ সংকটে পড়বে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বাজারের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তেমন জীবাণুনাশক স্প্রে করার উদ্যোগ নেয়া না হলেও তারা নিজেরাই চেষ্টা করছেন বাজার পরিচ্ছন্ন রাখার।
বাজারে আসা ক্রেতাদের মাঝে সচেতনতার কিছুটা নমুনা দেখা গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বাজার করতে গত সাত বছর ধরে কারওয়ান বাজারে আসেন সিএনজি অটোরিকশাচালক খলিলুর রহমান। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় তার মুখে মাস্ক ছাড়া আর কোনো সুরক্ষা উপকরণ নেই। তিনি জানান, তার পক্ষে এরচেয়ে বেশি সুরক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় বাজারে না এলে তার পরিবারের ছয় সদস্যকে না খেয়ে থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই বলছেন, কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে বাজারের লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন দেশব্যাপী বিস্তৃত। এ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন আমাদের সামাজিক সচেতনতার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করারও তাগিদ দেন তিনি।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা জানান, এরই মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে ঝুঁকি মোকাবেলায় রাজধানীর বাজারগুলোকে একমুখী করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এক মিটার দূরত্ব রেখে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কেনাবেচার কাজ সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে এরই মধ্যে বার্তা দেয়া হয়েছে। ##