সারা রাত লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, কেউ ছুঁয়েও দেখেনি

771

*নারায়ণগঞ্জে জ্বর ঠান্ডায় সঙ্গীত শিল্পীর মৃত্যু

মিরর বাংলাদেশ  :সোমবার রাত প্রায় দুইটা। জ্বর সর্দিসহ প্রচণ্ড শ্বাস কষ্টে মারা যান নারায়ণগঞ্জের সংগীতাঙ্গনের অত্যন্ত প্রিয়মুখ বেজ গিটারিস্ট রাকিব ওরফে হিরু। মৃত্যুর পরপরই তার মরদেহ চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে এনে ফেলে রাখা হয় রাস্তায়। কোনো খাট ছিল না। কোনো আগরবাতি জ্বলছিল না। এমনকি একটা মানুষও ছিল না লাশটির কাছে! সারারাত লাশটি রাস্তায়ই পড়েছিল।
এর আগে তার শারীরিক অবস্থার যখন অবনতি হয় তখন তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে পরিবারের লোকজন। অ্যাম্বুলেন্স আসে। কিন্তু রোগীর জ্বর-সর্দি এবং শ্বসকষ্ট রয়েছে অর্থাৎ তার করোনার উপসর্গ! এমনটা জানতে পেরে অ্যাম্বুলেন্স চালকও গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তাকে আর হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়া যায়নি। ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসার অভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভীষণ রকম যন্ত্রণায় ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অনেকের প্রিয় বেজ গিটারিস্ট হিরু।
হিরুর থাকতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া মোড়ের রতন ও ইকবালের বাড়িতে। দেড় বছরের ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে এখানেই বসবাস করতেন তিনি। সাথে হিরুর বোনও থাকতেন। পরিবারের বাকি সব সদস্যরা ঢাকায় বসবাস করেন। পরিবারের কোনো পুরুষ লোক ছিল না। এলাকাবাসীও এগিয়ে আসেনি। যার কারণে বেওয়ারিশ লাশের মতই হিরুর মরদেহটি রতভর পড়েছিল রাস্তার ধারে।
এদিকে রাস্তায় লাশ পড়ে থাকার খবর পৌঁছায় সিটি করপোরেশনের কাছে। প্যানেল মেয়র-১ আফসানা আফরোজ বিভা ঘটনাস্থলে ছুটে যান তার টিমসহ স্থানীয় থানা পুলিশ নিয়ে। তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন এবং সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় লাশ দাফনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এই প্যানেল মেয়রের ভাষ্য মতে, বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয় বিধারক।
আফসানা আফরোজ বিভা জানিয়েছেন, হিরু গত দুই বছর ধরেই স্কিনজনিত রোগে ভুগছিলেন। এরমধ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে তার জ্বর-সর্দি ও শ্বাস কষ্টের সমস্যা শুরু হয়। পরে শহরের একজন প্রাইভেট ডাক্তারকে দেখালে বেশ কিছু পরীক্ষা করানো হয়। এতে তার ফুঁসফুসে পানি জমা ছিল বলে চিকিৎসকেরা জানায়। এবং ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে ওষুধ খেতে বলেন, এতেই সেরে যাবে। কিন্তু জ্বর সর্দি আর শ্বাস কষ্ট না কমায় তার পরিবার এরমধ্যে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে চিকৎসকের ভর্তি না নিয়ে পুনরায় ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে তাকে ছেড়ে দেন।
তিনি আরও জানান, সোমবার তার শ্বাস কষ্টের সমস্যা আরও প্রকট হয়। এরমধ্যে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে তিনি বাড়িতেই মারা যান। পরে তার মরদেহ বাড়ির বাইরে এনে রেখে দেয়া হয় এবং লাশের কাছে ভয়ে আর কেউ আসেনি। সারারাত লাশটি সেখানেই পরেছিল। সকালের দিকে খবর পেয়ে স্থানীয় থানা পুলিশ, এবং আমার টিমসহ ঘটনাস্থলে যাই। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এদিকে হিরোর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সোমবার রাতে হিরোর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফের ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেন। হিরুকে বাইরে আনা হয়, অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোরও প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু জ্বর-সর্দি শ্বাস কষ্টে ভোগা রোগী, এমনটা শুনে করোনা আতঙ্কে চালক পালিয়ে যায়। এরপরই সে মারা যায়। ফলে তার মরদেহ আর বাড়িতে না ঢুকিয়ে গেটের কাছেই ফেলে রাখা হয়।
এদিকে একটি পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, হিরুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তার পরিবার। কিন্তু এলাকাবাসী প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে দিবে না এবং বের হতেও দিবে না জানিয়ে বাধাও দিয়েছিলেন। তবে, এ অভিযোগটি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন ফতুল্লা মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) তরিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমি নিজেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। একজন প্যানেল মেয়রও ছিলেন। আমি তার মায়ের সাথে কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর জন্য হিরুকে উঠানো হচ্ছিলো। এরমধ্যে চালক ও অ্যাম্বুলেন্সে থাকা অন্যরা বলছিলেন সে মারা গেছে তাকে আর ঢাকা নিয়ে কী হবে। এরপরই লাশ বাড়ির কাছে ফেলে রেখেছিল। করোনা আতঙ্কে কেউ আর কাছে আসেনি। তার লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেছে সিটি করপোরেশন। সেখানে পুলিশের টিম রয়েছে।