মিরর বাংলাদেশ : মেয়ের উপর নির্যাতনের খবর শুনে ব্যবসায়ী বাবা খলিল হাওলাদার হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন। বিধাব মা এবং দু’বছরের বড় অবিবাহিত বোনের সামনেই চালাতো অমানুুষিক নির্যাতন । হ্যাঁ নারায়ণঞ্জ শহরের এক সময়কার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আমিন মাকসুদের শ্যালক নারায়ণগঞ্জ যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহ ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজের (বর্তমানে কারগারে) স্ত্রী নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা শুনুন ফয়েজের স্ত্রী আরোহীর মুখে ………….
‘ও আমার সুন্দর জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে সে। বিমানে চাকরি করা হলো না আমার। আমি আমার ক্যারিয়ার হারিয়েছি, সমাজে অপমানিত হয়েছি। আমার হারানোর আর কিছু নেই। এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি।’
আরোহী জানান, তিন মাসের শিশু সন্তান, বিধবা মা ও এক বোনকে নিয়ে এক প্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। ভয়ে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। তার উপর সারাক্ষণ আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যাওয়া একদল বখাটে যুবক।
আরোহীর অভিযোগ, তার স্বামী যুবলীগ নেতা হওয়ায় কারাগারে থেকেও নানাভাবে প্রভাব খাটাচ্ছেন। মামলা তুলে নিতে তার নিজস্ব লোকজন বাড়িতে এসে মেরে ফেলাসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবারর নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন এবং যে কোনো সময় বাসায় হামলার আশঙ্কা করছেন তিনি।
ছবি : স্ত্রীর মামলায় বর্তমানে কারাগারে যুবলীগ নেতা ফয়েজ।
২০১০ সালে গাজীপুরে আততায়ীদের হাতে খুন হওয়া সন্ত্রাসী নুরুল আমিন মাকসুদের শ্যালক এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহ ফয়েজউল্লাহ ফয়েজের (৫০) দ্বিতীয় স্ত্রী এই আরোহী হাওলাদার।
নারায়ণগঞ্জ শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে ৩৬/১ হোল্ডিংয়ের ইলিয়াসের ১০ তলা বাড়ির ৭ম তলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিভাগে চতুর্থ সেমিস্টারে পর্যন্ত পড়াশুনা করেও স্বামী ফয়েজের চাপের মুখে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
আরোহী বলেন,‘আমার স্বপ্ন ছিলো জীবনে বড় কিছু হবো। সেই আশা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের আকাশ বাংলা, রিজেন্ট এয়ারলাইনস এবং ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি। মৌখিক পরীক্ষার দিন ফয়েজ রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে আটকে রেখেছে যাতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারি।’
অন্যদিকে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফয়েজ এর আগে তার দুলাভাই সন্ত্রাসী নুরুল আমিন মাকসুদের ভাগ্নি সোনিয়া ফারজানা সোমাকে বিয়ে করেন। ওই সংসারে ফয়েজের তিনটি মেয়ে। জামতলা এলাকায় রূপায়ন টাউনের ১৩ তলায় একটি ফ্ল্যাটে ফয়েজের এই পরিবার বসবাস করে।
আরোহী হাওলাদার জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে তিনি মেয়েদের রেডিমেট পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৮ সালে শহরের চাষাঢ়ায় বেইলি টাওয়ারের নীচতলায় আরোহী প্লাস নামে একটি ফ্যাশন হাউসের শো রুমের মধ্য দিয়ে তার ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। তবে ওই ভবনের ৬ তলায় স্ত্রী সোমা ও তিন মেয়েকে নিয়ে থাকতেন যুবলীগ নেতা ফয়েজ। সেই সুবােেধ ফয়েজ স্ত্রী ও মেয়েদের পোশাক কিনতে আরোহীর শো রুমে নিয়মিত আসতেন এবং আরোহীর প্রতি নজর দেন। কয়েকবার কুপ্রস্তার দিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
আরোহী বলেন, আমার সমবয়সী মেয়ে আছে যার সেই লোককে বিয়ে করা প্রশ্নই আসে না। তবে ফয়েজ আমার পিছু লেগে থাকেন। অপ্রয়োজনে আমার শো-রুমে বসে থাকতেন এবং বিয়ে না করেও আমকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচিত সবাইকে বলে বেড়াতেন। পরে আমার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পিস্তল দেখিয়ে আমাদের পুরো পরিবারকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারাসহ নারায়ণগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দেন। সে সময় তার এই হুমকির বিষয়ে ফতুল্লা থানায় জিডি করেও আমি কোন আইনি সহায়তা পাই নি। তখন আরোহীর পরিবার থাকতেন জামতলা ধোপাপট্টি এলাকায়। ফয়েজদের পৈর্তৃক বাড়ির খুব কাছে। বাইরে আসা যাওয়ার পথেও আরোহীকে নানাভাবে উত্যক্ত করতো এবং কয়েকদিন রাস্তায় চড় থাপ্পড় দিয়েছে বলেও আরোহীর অভিযোগ।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি তারিখে অস্ত্রের মুখে জম্মি করে তুলে নিয়ে কাজী অফিসে জোর করে তাকে বিয়ে করেন ফয়েজ। এরপর আরোহীর লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। আল্লামা ইকবাল রোডে ইলিয়াসের ১০ তলা বাড়ির ৭ম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফয়েজ সেখানে আরোহীকে নিয়ে রাখেন। মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া করেন। বেশিরবাগ সময়ই রাতে থাকেন অন্যখানে।
বিয়ের পর ১০ লাখ টাকা যৗতুক দাবি করে আরোহীর উপর ফয়েজের নতুন করে অত্যাচার শুরু হয় বলে অভিযোগ করেন আরোহী। টাকার দাবিতে প্রতিনিয়ত চলতে থাকে মারধর ও মানসিক নির্যাতন। এই খবর শুনে ব্যবসায়ী বাবা খলিল হাওলাদার হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। মা এবং দু’বছরের বড় অবিবাহিত বোন আরোহীর ফ্ল্যাটে এসে উঠেন। মা বোনের সামনেই গর্ভবতী আরোহীকে মারধর করতে থাকেন ফয়েজ। বিয়ের কয়েক মাস পর আরোহীর ব্যাংক এ্যাকাউন্টের ক্রেডিট কার্ড ও নম্বর চুরি করে তিনদিনে কয়েক দফায় দুই লাখ টাকা তুলে নেন ফয়েজ। মোবাইলে টাকা উত্তোলনের ম্যাসেজ পেয়ে বিষয়টি আরোহীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এতে ফয়েজ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং তার ফ্যাশন হাউস শো রুম বিক্রি করতে বাধ্য করেন। শো রুম বিক্রি বাবদ আরোহীর পাওয়া আট লাখ টাকা ফয়েজ আত্মসাৎ করে নিয়ে যান। পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েন এই তরণী। এর মধ্যে গত তিন মাস আগে সিজারের মাধ্যমে আরোহীর কোলে জন্ম নেয় তাদের ফুটফুটে পুত্র সন্তান আজওয়াদ ফয়েজ ফাইজান।
আরোহীর অভিযোগ, গত ২৮ মার্চ সকাল থেকেই স্বামী ফয়েজ দুই লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে কয়েক দফায় মারধর করেন। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার মুখমন্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করেন। তার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে। চেহারা ফেটে রক্তাক্ত হয়। পরে তার মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট, ব্যাংকের চেক বই, ক্রেডিট কার্ড ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সার্টিফিকেট নিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যান। শারীরিক নির্যাতনে আহত হয়ে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে মায়ের মোবাইল ফোন দিয়ে ট্রিপল নাইনে ফোন করেন আরোহী। পরে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-১১ কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিনের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়ে সহযোগিতা চান। পরে পুলিশ তাৎক্ষণিক গিয়ে তাকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে র্যাব-১১ কার্য্যালয়ে গিয়ে আলেপ উদ্দিনের সাথে সরাসরি দেখা করে নির্যাতনের ঘটনা বিস্তারিত জানান। এই র্যাব কর্মকর্তার সহায়তায় ওইদিন রাত নয়টায় শহরের জামতলা এলাকা থেকে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজকে ফতুল্লা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে।
পরদিন রবিবার দুপুরে ফয়েজকে পুলিশ বিশেষ আদালতে হাজির করলে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারি ছুটি চলায় আদালত জনশূণ্য থাকার সুযোগে ওইদিন বিকেলে আদালত প্রাঙ্গনে ফয়েজের লোকজন আরোহীকে আটকে রেখে মামলা তুলে নিতে এবং আপোসনামায় স্বাক্ষর করতে প্রভাব খাটান এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেখানেও পুলিশের জরুরী পরিসেবা-৯৯৯ এ ফোন করে র্যাব ও পুলিশের সহযোগিতায় আদালত থেকে রক্ষা পান আরোহী।
তবে সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে একদল বখাটে যুবক তাদের বাড়ির গেটে এসে নিরাপত্তা কর্মীকে গেট খুলতে বলে। গেট না খোলায় ফোনে আরোহীকে ডেকে দিতে বলে যুবকরা। পরে নিরাপত্তা কর্মীর ফোন পেয়ে আরোহীর বড় বোন ও মা নীচে নেমে এলে ওই যুবকরা মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়। মামলা তুলে না নিলে আরোহীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয় তারা।
আরোহী বলেন, ফয়েজের আঘাতে আমার মাথার বিভিন্ন স্থানে ফুলে গেছে। ডাক্তার সিটিস্ক্যান করতে বললেও হুমকির কারণে বাসা থেকে বের হতে পারছি না। পুরোপুরি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
আরোহীর মা লুৎফা বেগম বেগম, আমার মেয়ের উপর পশুর মতো নির্যাতন করতে দেখে আমি ফয়েজের পা পর্যন্ত ধরেছি। তাতেও সে থামেনি। তার অত্যাচারে আমার মেয়ে আরোহী গত এক বছরে তিন থেকে চারবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। ফয়েজের নির্যাতনে একবার গলায় ফাঁস দিয়েছিল। আরো দুই তিনবার স্যাভলন ও হারপিক খেয়ে মরতে চেয়েছিল।
ফতুল্লা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসলাম হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, কোন হুমকিতে কাজ হবে না। মেয়েটির নিরাপত্তার বিষয়টি আমি নিজে দেখব। আমি নিজে মামলা গ্রহণ করে আসামিকে গ্রেফতার করিয়েছি। আমি মেয়েটির পাশে ছিলাম আছি এবং থাকবো। কেউ যাতে তার কোন ক্ষতি করতে না পারে সে বিষয়টি দেখছি বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
এ ব্যাপারে র্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক আলেপ উদ্দিন বলেন, গত শনিবার ট্রিপল নাইনের সহায়তায় মেয়েটি আমার সাথে যোগাযোগ করলে আমি তাকে দেখা করতে বলি। তিনি আমার সাথে দেখা করলে তার চেহারায় নির্যাতনের আঘাতের অনেক চিহ্ন পাই। তাৎক্ষণিক আমি এই মেয়ের অভিযোগ গ্রহণসহ আইনি সহায়তা দিতে ফতুল্লা থানা পুলিশকে অনুরোধ করলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে এবং তার স্বামী ফয়েজকে রাতে গ্রেফতারও করে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারের নির্দেশে আমরাসহ আইন শৃংখলা বাহিনী বিশেষ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত রয়েছি। এই নির্যাতিত মেয়ের বিষয়টি বর্তমানে ফতুল্লা থানা পুলিশ দেখছে। মেয়েটির নিরাপত্তার বিষয়টিও পুলিশ দেখবে বলে আমি আশা করছি।