হাটের নাম “কাইকারটেক”

1060

ছবি : কাইকারটেক হাটের সারি সারি নৌকার ছবি তুলেছেন সিনিয়র ফটোসাংবাদিক এম এ সুমন

মিরর বাংলাদেশ  দোকান বসেছে, পসরা সাজানো হয়েছে হাটে। দলে দলে লোকজন আসছে কেনাকাটা করতে। কী নেই এই হাটে! কবুতর, জাল, দা, কুড়াল, জামাকাপড়, গরু-ছাগল, মিষ্টি, মাছ, হাঁস-মুরগিসহ নিত্যব্যবহার্য সবকিছুই রয়েছে। আম, জাম লিচু, দুধ, কলাসহ গৃহস্থের ঘরের একটা-দুইটা কাঁঠাল।

 


খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঘর বানানোর আসবাবপত্র। শখ করে মাছ ধরার জাল কিংবা ছই। পাওয়া যায় ডিঙ্গি নৌকা। কিংবা সবুজ বনায়নের জন্য গাছগাছালি । আরো পাওয়া যায় অনেক শখের জিনিস। বর্ষাকাল এলে জমজমাট বাড়ে। সাথে সাথে বাড়ে দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামীণ পরিবেশের একটি হাট দেখার কিংবা দর্শক ও ক্রেতা। হাটের নাম কাইকারটেক। প্রতি সপ্তাহের রোববার বসে এ হাট। এক দুই মাস কিংবা এক দুই বছর নয়, প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে আসছে কাইকারটেক হাট। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটা রোববারের হাট নামে পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার মোগরাপাড়া পুরাতন ব্রহ্মহ্মপুত্র নদের তীরে হাটটির চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরূপ। হাটের পাশেই রয়েছে কাইকেরটেক ব্রিজ। ব্রিজ থেকে যেদিকেই তাকানো যায় চোখে পড়বে অবারিত সবুজ। হাটে বিক্রি হওয়া মজার মজার খাবারের স্বাদ মুগ্ধ করে আগন্তুকদের। এ হাটের অন্যতম আকর্ষণ বিশেষ ধরনের এক মিষ্টি। এ মিষ্টির জন্য শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, আশপাশের জেলা থেকেও মানুষ আসে এখানে।
গত রোববার সরেজমিন দেখা যায়, নানা বয়সের মানুষের আগমন। বিক্রেতারা তাদের পণ্য সাজিয়ে রেখেছে মাটির ওপর বিছানো হোগলা পাতার বিছানায়। বিক্রেতাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এই হাটে পুতা মিষ্টি নামে এক প্রকার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পাওয়া যায়, যার স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। মিষ্টিটি দেখতে স্বাভাবিক মিষ্টির চেয়েও কিছুটা বড়। অনেকটা শিলপুতার মতো। এ মিষ্টির জন্য এখানে ছুটে আসে অনেক মিষ্টিপ্রেমী।


মিষ্টি বিক্রেতা রাজীব ঘোষ জানান, কাইকারটেকের হাটে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে মিষ্টি কিনতে। একটা মিষ্টির ওজন প্রায় আধা কেজি। তবে অর্ডার দিলে এক কেজি পরিমাপের একটা পুতামিষ্টিও তৈরি করে দেই আমরা।
শুধু মিষ্টি নয়, এখানে বিক্রি হয় হাসেম মিয়ার বিশেষ ঝালমুড়ি, বুট, মোয়াসহ নানা ধরনের লোকজ খাবার। এ ছাড়াও প্রায় ৫০ পদের মাছের শুঁটকিও এখানে খুব নামকরা। কম দামে ভালোমানের কোষা নৌকা বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ কাইকারটেক হাটে নৌকা কিনতে ভিড় জমায় নারায়ণগঞ্জের আশপাশের জেলার শত শত ক্রেতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়।


জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলার মানুষের কাছে এটি কাইকারটেক হাট নামেই পরিচিত। স্থানীয়দের দাবি, ঐতিহাসিক এই কাইকারটেক নৌকার হাটটি প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। হাটের প্রাচীন নিদর্শন ও পাতাঝরা কড়–ই গাছগুলো যেন হাটের বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাটে আসা বিশাল সব বাঁশ আর নৌকা নিয়েই তার যত প্রশ্ন। শেষ প্রশ্নটা ছিল এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছে, ‘চাচা, কাইকারটেকের এই হাটের বয়স কত?’ উনি উত্তর দেয়ার আগেই যুবক মাহতাব মিয়ার উত্তরÑ ‘দাদার মুখে শুনেছি, ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের এই হাটের বয়স প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছরের মতো। তার সাথে সুর মেলালেন পাশে বসা মাছ ধরার জাল বিক্রেতা মুসা মিয়া। তার বয়সও ৭০-এর কোটায় । তিনি জানালেন আমার দাদার আমল থেকে এ হাট বসতে দেখে আসছি। এখানে জিনিসপত্র খুবই সস্তায় পাওয়া যায়। তাই দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে।

বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। বেপারিদের দেখা যায় নৌকা নিয়ে বসে থাকতে, নৌকার বিক্রিও কম না। ছোট-বড় সেসব নৌকা বিক্রি হচ্ছিল দেদার। বিশাল সব বাঁশ ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে লাইন করে সাজানো। হতশ্রী নদীর পাশে বাঁশের সে দৃশ্য দেখার মতো। একেবারে মনোরম যাকে বলে ঠিক তাই। নৌকা বিক্রেতা নাসিম আলম জানান, বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় অনেকে নৌকা কিনতে এখানে আসে। কারণ বর্ষাকালে আশেপাশে থইথই পানি থাকে। অনেকে শখ করে নৌকা কেনে অনেক বাধ্য হয়ে কেনে।

ছবি কৃতজ্ঞতায় সিনিয়র ফটোসাংবাদিক এম এ সুমন