আজও ফরিদপুর ঝিমিয়ে পড়েনি

239
রফিকুল ইসলাম (এহ্সান)
সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক ও জীবনের মৌলিক গবেষক
ফরিদপুরই হচ্ছে বঙ্গ। ঢাকা ছিলো তার হেড কোয়াটার্স বা প্রধান কার্যালয়।
বুকের মতো মর্যাদা সম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গকে মধ্যমনি করে সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, মহাস্থান, বরেন্দ্র ও গৌড় অঞ্চলরা মিলিত হয়। তারপর ভূখন্ডটির নাম হয় বঙ্গদেশ।
দূর অতীতে আপামর জনতার স্বার্থে আমরা আমাদের প্রিয় জেলা ফরিদপুরের হেডকোয়াটার কাম রাজধানীকে জনস্বার্থে ছেড়ে দিয়ে বর্তমান ফরিদপুরে চলে যাই।
এটা কী কম সেক্রেফাইস?
এখনো আমাদের সেই পুরোনো জায়গা ঢাকা দিয়ে দেশের সবাই হাঁটা চলাফেরা করে। আমরা কিচ্ছু কইনে! ক্যান কবো? আমরা ফরিদপুরেরা রাজা হয়ে যদি দেশের মানুষকে এতটুকু ছাড় দিবার না পারি, তাহলে কি খন্দকার মোশতাকের অঞ্চল বা তার উত্তরসূরীরা সেটা দেবে? এটা আমার নিজস্ব মতামত। ডোন্ট মাইন্ড, কেউ আহত হবেন না।
ফরিদপুর থেকে এসে দেশটারে স্বাধীন করে দিলেন শেখ লুৎফর রহমানের বড়ো ছাওয়াল শেখ মুজিবুর রহমান। তা কোনভাবেই সহ্য করতে পারলো না খন্দকার মোশতাক।
অনেক কিছু জানার পরও বৃহৎ/উদার মনের কারণে তিনি/মুজিব মোশতাককে ফেলেও দিতে পারলেন না। ক্যান দেবে? ফরিদপুরেরা ফেলে দিলে মানুষেরা যাবে কোথায়? সেই মোশতাকের কি এটা করা ঠিক হইছে, বলেন? মোশতাকদের কেউ মনে রাখে না। এটাই ইতিহাসের নির্মম নিয়ম।
এখনো ইনশাল্লাহ তা’য়ালা গোটা/সারা দেশ ফরিদপুরকেই পূজো অর্চনা করছে।
আমার সাবেক জেলা ও আজকের বৃহত্তর যশোরের নড়াইল-মাগুরা কিন্তু বঙ্গ তথা প্রাচীন ফরিদপুরেরই অংশ। সেখান থেকে এসেছে আমাদের ছোট ভাই-ব্রাদার বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে পৃথিবীর বেশি মানুষ সাকিবকে চেনে বলে আমার মনে হয়। আর নড়াইল এক্সপ্রেসখ্যাত মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা না-ই বললাম।
আমরা ফরিদপুরেরা কিন্তু সবার সাথে খেলতে মাঠে নামিনে। আমরা ১৯৭১ সালে একবার খেলার মাঠে নামছিলাম লিয়াকত আলী ও আইয়ুব খানের উত্তরসূরী ইয়াহহিয়া ও টিক্কা খানদের সাথে। বেনজিরের বাপ জুলফিকার আলী ভূট্রোও সেই খেলায় আমাদের বিরুদ্ধে অংশ নিছিলো। সে কী খেলা! গোটা দুনিয়া সেই খেলা দ্যাখলো। ফলাফলতো বিশ্ববাসীর জানাই আছে, বলবো আর কী! প্লেয়ার পছন্দ না হলে আমরা ফরিদপুরেরা সহসা খেলার মাঠে নামিনে। এটা আমাদের অভ্যেস ও রুচিগত ব্যাপার-স্যাপার বলতে পারেন।
দেশের সকলকেই মাথায় রাখতে হবে যে, ফরিদপুর হলো- বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান জেলা। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন জেলা/অঞ্চল এদেশে নেই। এ জেলার পূর্বনাম ছিল ‘বঙ্গ’, ‘জালালপুর’ ও ‘ফতেহাবাদ’। সুলতানুল হিন্দ, আতায়ে রসুল (রসুলের উপহার) দরবেশ খাজাবাবা মঈনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর প্রশিষ্য বাবা শেখ ফরিদ (রহঃ) এর নামানুসারে সবশেষে এ জেলার নামকরণ হয় ফরিদপুর।
ষষ্ঠ শতকের শিলালিপিতে ফরিদপুরের রাজা সিংহবর্মা ও তার পুত্র চন্দ্রবর্মার নাম দেখতে পাওয়া যায়। সুমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক চন্দ্রবর্মা পরাজিত হলে আদি ফরিদপুর গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ও শেষ রাজার একটি স্বর্ণমুদ্রা ও চারটি তাম্রলিপি ফরিদপুরের ইতিহাস ও শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের কথা জানান দিয়েছে। এই তাম্রলিপিতে ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র, ও সমাচার দেব নামের তিনজন রাজার নাম পাওয়া গেছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, গুপ্তযুগের রাজধানীর অবস্থান ছিলো- এই ফরিদপুরে।
বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আবিস্কৃত ফরিদপুরের রাজাদের কয়েকটি স্বণমুদ্রা ঢাকার জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। মুদ্রা তত্ত্ববিদদের মতে, এই মুদ্রাগুলি বঙ্গদেশে (ফরিদপুর) প্রচলিত খ্রিস্টীয় সপ্ত-শতাব্দীর মুদ্রা। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড়রাজ মাধবগুপ্ত’র আমলে ফরিদপুর জেলা সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অনেক উন্নত ছিলো। ইনশাল্লাহ তা’য়ালা আজও ঝিমিয়ে পড়েনি, আমাদের গর্বের ফরিদপুর। এখনো সে মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। পরেরটা পরে।
ফরিদপুরের রাজাদের মধ্যে সবথেকে প্রভাবশালী ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বি রাজা পূর্ণচন্দ্র। পরবর্তীকালে সেন রাজাদের রাজত্বকালে ফরিদপুরসহ সমগ্র পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের জাগরণ ঘটে। এই সময় বর্ণ-বৈষম্য চরমে ওঠে। সতীদাহসহ প্রভৃতি ধর্মীয় রেওয়াজ-রীতির প্রচলন শুরু হয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লালসেন ১১৫৯-১১৮৫ সালে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিদ্রোহ করেন। তাই সেন-রাজত্বের শেষের দিকে লক্ষণ সেন ভীত হয়ে নদীয়া থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। অনেকের মতে, তিনি ফরিদপুরের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ঐতিহাসিকরা বলেন, লক্ষণ সেনের ছাত্র বিশ্বরুপ সেন ও কেশব সেন প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের খুলনা শাসন করেন। জেনে রাখা ভালো যে, ১৩৪১ সালের পূর্বে চন্দ্রদ্বীপ তথা আজকের বরিশালও ফরিদপুরের রাজাদের অধিনে ছিলো।
মামলুক বংশীয় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (১৩০০-১৩১২) কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা ফরিদপুর তথা খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। ইলিয়াস শাহী বংশের পতনের পর পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গ তথা ফরিদপুরের রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন হিন্দু রাজা গনেশ।
ভালো করে জেনে রাখতে হবে যে, এই ফরিদপুর তথা বঙ্গ থেকে ঢাকাতে এসেছিলেন শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। নতুন প্রজন্মদের মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক জাতির জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকে।
ওই ঘটনার সাথে সেখানকার একজন বিশেষ ব্যক্তি জড়িয়ে পড়ে তিনি সামনে থেকে বিরত্বের সঙ্গে সেই ঘটনা ট্যাকেল করে ঐ জনগোষ্ঠির/ভূখন্ডের জাতির পিতা হন।
যেমন- মার্কিনীদের জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার প্রথম পিটার, চীনের সান ইয়াত সেন, ইরানের দ্বিতীয় কুরুশ, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, পাকিস্তানের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, মালয়েশিয়ার টাংকু আবদুর রহমান, আফগানিস্তানের আহমদ শাহ্ দুররানী ও বাংলাদেশের (শেখ হাসিনার বাবা) শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতির পিতা কোন যেনতেন ব্যাপার নয়। উপরোক্ত ব্যক্তিগণ সকলেই যার যার দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যাপক ভূমিকা রেখে জাতির পিতায় পরিণত হয়েছিলেন। আমাদের জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড়ো ঘটনা আর একটিও নেই। দেশে দুটো দল/গ্রুপ রয়েছে। এর একটি মুক্তিযুদ্ধ/স্বাধীনতার চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় আর অন্য গ্রুপটি তা পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারেন, তারা হলেন- মেইন স্ট্রিম সিটিজেন। আর যারা বিপরীতমুখি, তারা হলো- আন্ডারগ্রাউন্ড সিটিজেন। ইটস্ মাই পারসোনাল ওপেনিয়ন। এই গোষ্ঠিটিই রাষ্ট্রের জন্মের আগে ও পরে সবসময়ই নানা কায়দায় সমাজ/রাষ্ট্রে বড়ো বড়ো ঝামেলা/বিশৃংখলা ঘটিয়েছে। যেমন: ৭৫ হত্যাকান্ড, ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা, দশট্রাক অস্ত্র, হযরত শাহজালালের মাজারে বোমা হামলা করে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে হত্যাচেষ্টা, জেলখানাতে জাতীয় চারনেতাকে খুনসহ একই সাথে ৬৩ জেলাতে বোমাবাজি ইত্যাদি।
আর এরা স্বাধীনতার আগে কী করেছে, তা আর নাই-বা বললাম!
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা/চলচ্চিত্র/মুভিগুলো দেখলেই বুঝা যায় যে, ১৯৭১ সালের সেই কঠিন দিনগুলিতে, এই জাতির কী অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে আর শেখ মুজিব-ই-বা তাদের জন্য কী করতে পেরেছেন।