আহ্ মিজান ভাই আহ্ !

560

ছবি  : প্রয়াত মিজানুর রহমান খান

আহমেদ আল আমীন ,লেখক ও সাংবাদিক   

অনার্স পরীক্ষা দিয়েই জাহাঙ্গীরনগর থেকে চাকরির জন্য ঢাকায় এলাম। প্রথম আলোতে লিফটের পাঁচ-এ গিয়ে রিসিপশনে বললাম, মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি তার এলাকার।
কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। সেই আমার প্রথম মিজানুর রহমান খান-দর্শন। এটা ২০১০ এর সেপ্টেম্বরের কথা। আগে তার লেখা পড়েছি প্রথম আলোতে। একজন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী হিসেবে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছি তাকে।

আমাদের থানা কল্যাণ সমিতির সুভ্যেনিরে তার প্রোফাইল দেখে তাকে চিনেছি। সেই সুবাদে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমাকে নিয়ে বসলেন পাশের একটি রুমে। আমি তার পাশে বসা। পাশাপাশি দুটি চেয়ার। টেবিলে আজকের পত্রিকার ফাইল।

ছবি : লেখক ও সাংবাদিক আহমেদ আল আমীন।

আমি আমার উদ্দেশ্য বললাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কাজ করি। অনার্স পরীক্ষা মাত্র শেষ হলো। মাস্টার্স পর্যন্ত হলে থাকা যাবে। চাকরি খোঁজার কাজটা আমি হলে থাকা অবস্থায়ই করতে চাই, শেষ করতে চাই। তাই এখনই চাকরির খোঁজে নেমেছি। যাতে মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই চাকরি হয়ে যায়। আর এভাবে ঢাকায় থাকার আর্থিক যোগ্যতাও অর্জন করতে পারি। আমি বিসিএস-টিসিএস দেবো না। আমার চিন্তা-ভাবনা শুধু লেখালেখি ও সাংবাদিকতা।

আমার বাবা কি করেন জানতে চাইলেন মিজানুর রহমান খান। আমি বললাম কৃষক। মিজানুর রহমান খান আমার উরু চাপড়ে বললেন, ‘কৃষকের ছেলেরাই একসময় ‘কিছু’ করে। সাংবাদিকতার কাজটা আগ্রহের বিষয়। আগ্রহ থাকতে হবে। লেগে থাকতে হবে। আমার কাছে এসেছেন। আপনি আমার সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন। দেখি।’

মিজান ভাই আমাকে তার ‘আইন-অধিকার’ পাতায় কাজ করার কথা বলছেন। মনে মনে বললাম, এতে তো আমার হবে না। আমি বললাম, আপনি কোথাও বলে দিলে একটু ভালো হয়। আমি এক্ষেত্রে দুএকটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করলাম। মিজান ভাই মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘একটা ওয়েল এস্টাবলিস্ট পত্রিকা আপনাকে হঠাৎ করেই নেবে না। এটা আমাকেও নেবে না। কাউকে নেবে না। আপনাকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। আপনি আমার সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন। তারপর দেখি।’
আমি প্রথম আলোতে আইন-অধিকার পাতায় কাজ শুরু করি। আমার সরাসরি বস-তানজিম আল ইসলাম। এখন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আমি জাহাঙ্গীরনগর থেকে সকালে এসে প্রথম আলোতে কাজ করি। বিকালে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে অফিস ত্যাগ করি। ক্যাম্পাসে ফিরতে সন্ধ্যা-রাত হয়ে যায়।

সফল মানুষেরা সাধারণত বেপরোয়া, অহঙ্কারী, আমি আমি ভাবের হয়ে থাকেন। মাটিতে পা রাখেন না। আচরণে ভদ্রতা বজায় রাখেন না। কিন্তু, মিজানুর রহমান খানের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ খাটে না। মিজান ভাইয়ের অধীনে কিছুদিন কাজ করে শিশুর মতো তার সরলতা, উদারতা, জ্ঞান, ভদ্রতা, সহযোগিতা, আন্তরিকতা, নিরহঙ্কার মনোভাব, আড়ম্বরহীন জীবনে অভ্যস্ততা দেখে বিস্মিত হয়েছি। এককথায় মাটির মানুষ। অসাধারণ একজন মানুষ এতো ‘সাধারণ’ হয় কি করে! কখনও এমন হয়েছে, কথাবার্তার মাঝখানে কিছু না বলেই আমার কাছ থেকে হঠাৎ চলে গেলেন। অথচ বিদায় সম্ভাষণই হয়নি। কিন্তু, মিজান ভাই চলে গেছেন! পরে মুখ টিপে হেসেছি, বুদ্ধিজীবীরা একটু ভুলোমনাও হয়!

দুই-আড়াই ঘন্টার জার্নি করে অফিসে আসতাম। সকাল ১১টায় অফিসে আসতে ৯টায় রওনা করতে হতো। কখনো আটটায় যাত্রা শুরু হতো। মাঝে মাঝে একটু হেরফের হতো। বললাম, ভাই, আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। জবাবে মিজান ভাইয়ের একটু হাসি। আর কিছু না। বললাম, আমাকে এখন যেতে হবে। জবাবে তার একটু হাসি। আর কিছু না। কখনও বলতাম, ভাই, এটা করবো? মিজন ভাইয়ের জবাব, ‘না।’ মিজান ভাই বলতেন, ‘এটা করেন।’ কখনও বলেননি, এটা কেন করেছেন, ওটা কেন করেননি। চড়া মেজাজ দেখিনি। আর দেখতাম, বিভিন্ন বই-পুস্তক ও কাগজে ঠাসা নিজের অগোছালো ছোট্ট রুমে কাজে বুঁদ হয়ে আছেন মিজানুর রহমান খান।

বেশ কিছু দিন পর একদিন ফোন করলেন মিজান ভাই। আমি অবাক এবং উৎফুল্ল। মিজানুর রহমান খান আমাকে ফোন করেছেন! এমআর খান নামে নম্বরটি সেভ করা। এমআর খান কলিং!
আপনি কাল মানবজমিনে সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। আমার কথা বলবেন। সিভি নিয়ে যাবেন। আমি দেখলাম আপনার আগ্রহ আছে।
আমি ‘জি ভাই, জি ভাই’ বলতে বলতে ফোন রেখে দিলাম। মানবজমিনে গিয়ে মতি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। মতি ভাই আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বললেন, ‘এতো বাচ্চা ছেলে!’ চিফ রিপোর্টার কাজল ঘোষ। কাজলদাকে ডেকে বললেন, ‘কাল থেকে এই ছেলেটা জয়েন করবে। মিজানুর রহমান খান পাঠিয়েছে।’

মিজানুর রহমান খানের নাম যেখানেই বলেছি, সবাই তার প্রশংসা করেছে। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছি, এটা আমার জন্য গর্ব ও সম্মানের বিষয়। এই ভালোলাগার আবেশ আমার হৃদয়ে জাগরূক থাকবে আজীবন। বাংলাদেশে আইন বিষয়ক সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকে অসাধারণভাবে সাধারণের উপযোগী করে তুলেছেন তিনি। তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় লেখাটি শৈল্পিকমাত্রা পেতো, আইন বিষয়ের লেখা পড়ে পাঠক মনে করতো সাহিত্য পড়ছি কিনা! সংবিধান ও আইনের ওপরে লেখা; কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসতো ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একজন বীর সেনানী মিজানুর রহমান খান আমাদের অপ্রস্তুত রেখে চলে গেলেন। কিছু বলে গেলেন না। মিজান ভাই, আপনি জানতে পারলেন না দেশের মানুষ আপনাকে কতোটা ভালোবাসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃত্যু-বিষয়ক স্ট্যাটাসেও হা-হা রিঅ্যাক্টের এই যুগে আপনার জন্য কতোটা কাঁদছে দেশের মানুষ। আপনি হয়তো মনে করেছেন, আপনি একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু, আমরা দেখছি মানুষ আপনাকে কতোটা মহান মনে করে। আপনি আমার মতো একটা ‘বাচ্চা’ ছেলেকে একদা এই ঢাকা শহরে আশ্রয় দিয়েছিলেন, প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আপনাকে স্মরণে রাখবো। এতো সহজে আপনার কাজকে ভুলে যাবো না। আপনি তো আপনিই।

(লেখাটি আহমেদ আল আমীনের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)