- কামাল উদ্দিন সুমন, সাংবাদিক দৈনিক নয়াদিগন্ত
মৃত্যু মানুষের জীবনে অনিবার্য। সকল মানুষকে কোন না কোন সময় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কেউ নয়। আল্লাহর ডাকে যখন কোন মানুষ মারা যায় তার ইহলোকিক জীবনের অবসান ঘটে মাত্র। তবে মৃত ব্যাক্তির কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। কিছু মানুষ আছে অনেকটা নীরবে নিবৃতে মানুষের খুবই আপনজন হয়ে থাকে তাদের মধ্যে একজন আমার খালু বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মুন্সি।
আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মুন্সি গত ২১ জুন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার দেলপাড়া খালপাড় এলাকায় নিজ বাড়িতে মারা যান। মতিউর রহমান মুন্সির সাথে আমার পরিচয় প্রায় ২৬ বছর আগে। ১৯৯৭ সালের কোন একসময় খালপাড় তার বাসায়। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিকে। বলে রাখি, মতিউর রহমান মুন্সি সোনালী ব্যাংকের একজন সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। তার একমাত্র ছেলে আতিকুর রহমান বিদ্যুতের সাথে আমার খুবই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। যদিও বিদ্যুৎ আমাকে শুরু থেকে বড়ভাইয়ের মতো সম্মান করে আসছে । বিদ্যুতের মা জনাবা গোলেনুর বেগম আমাকে মায়ের মতোই আদর করতেন।
যেদিন মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মুন্সির সাথে আমার দেখা হয় শুরুতেই তিনি আমাকে তার ছেলের মতো সমাদর করলেন। আমি সাংবাদিকতা করছি এটা শুনে আমার প্রতি তার আদরটা আরো বাড়িয়ে দিলেন। সে দিন তাদের বাসায় গরুর মাংস খিচুড়ি রান্না করা হয়েছিল । বাসার সোফাতে বসে তাদের সাথে আমাকেও খেতে দিলো। খিচুরি খাওয়া সাথে গল্প শুরু করে দিলেন আমার খালু মতিউর রহমান মুন্সি। শুরু থেকে মতিউর রহমান মুন্সিকে আমার কাছে স্পষ্টবাদী একজন মানুষ মনে হয়েছিল। কোন অন্যায়ের সাথে তিনি আপোষ করেননি। যা ভাবতেন তা বলে ফেলতেন । কারোর কাছে মাথা নত করেননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার এ অবস্থান আমার কাছে ষ্পষ্ট ছিল। তিনি আমাকে সুমন নাম ধরেই ডাকতেন। মাঝে মাঝে সাংবাদিক ডাকতেন ।
ফোন করে বলতেন সাংবাদিক, খালু বলছি। ২৬ বছর ধরে আমার দেখা এমানুষটা আমার জীবনে কত যে উপকার করেছে তার কোন হিসেব নেই। আমার জীবনে দীর্ঘ সময়ে অসংখ্যবার নানা বিষয়ে তার স্মরণাপর্ণ হয়েছি। আমার অনেক কস্টের কথা তার সাথে শেয়ার করেছি। তিনি আমাকে সাহস দিয়েছেন। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ফেরারী জীবন যাপন যাপন করছি। কিন্তু যতবারই আমার খালু মতিউর রহমান মুন্সির সাথে দেখা হয়েছে তিনি বলেছেন, তোমার মতো একজন সৎ সাহসী সাংবাদিক অনেক প্রয়োজন। এগিয়ে যাও বাবা। কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না।
৯৮ সালের দিকে “সন্ত্রাসের জনপদ কুতুবপুর” জাতীয় দৈনিকে ধারবাহিক সিরিজ নিউজ প্রকাশের কারনে অনেকটা নিরাপত্তাহীনায় পড়ে যাই। প্রতিনিয়ত আসতে থাকে প্রাণ নাশের হুমকি। সেই সময়ের কুতুবপুরের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা বাসায় গিয়ে দিনে রাতে আমাকে খুজতে থাকে। একসময় পালিয়ে ফেরারি হয়ে যাই। কিন্ত অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি। প্রমান করেছি সাংবাদিকরা কাউকে ভয় করে না। সেই সময় মতিউর রহমান রহমান মুন্সি আমাকে অনেক সাহস যোগতেন। কুতুবপুরের সন্ত্রাসীদের কাছেও সাংবাদিক সুমন একটা আতংক ছিল। প্রচার ছিল, সাংবাদিক সুমন কোন সন্ত্রাসীকে তোয়াক্কা করে না।
তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্নাসের ছাত্র আমি। একদিকে পড়াশুনা অন্যদিকে সাংবাদিকতা এটা নিয়ে জীবন। এসবের পাশাপাশি ২/৩টা টিউশনিও করতাম।
২০০০ সালের দিকের কথা । আর কয়েকদিন পরেই ঈদুর ফিতর। আমার পকেটও খালি। অনেকটা চিন্তা পড়ে গেলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। এরই মধ্যে আমি মতিঝিলে গেলাম কোন এক কাজে। মনে হলো খালু মতিউর রহমানের সাথে দেখা করি। টাকা পাবো এই আশায় না। তার ব্যাংকে যাওয়ার পর তিনি আমাকে ২শ টাকা দিলেন। তখন ২শ টাকার অনেক দাম ছিল। কারন ঢাকা নারায়ণগঞ্জে তখন বাস ভাড়া ১০ টাকা । জালকুড়ি থেকে আমরা ছোট মিনিবাসগুলোতে ঢাকায় যেতাম ৫টাকা করে। সেদিনের খালুর দেয়া ২শ টাকা পেয়ে আমার চোখে পানি চলে এলো। মন থেকে তার জন্য দোয়া করলাম। আজও আমার সেই ২শ টাকার কথা মনে হয়।
মতিউর রহমান মুন্সি একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একজন নির্ভেজাল সমর্থক ছিলেন। জীবনের শেষ মুহুত্ব পর্যন্ত আওয়ামীলীগের জন্য, শেখ হাসিনার জন্য তার অন্ধ ভালোবাসা মানুষের মনে থাকবে। আওয়ামীলীগের কোন সমলোচনা তার কাছে এলেই তিনি কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করতেন। যুক্তিদিয়ে বুঝিয়ে দিতেন কেন তিনি আওয়ামীলীগকে এতটা ভালোবাসেন।
মতিউর রহমান মুন্সির সাথে আমার শেষ দেখা মৃত্যুর ৩দিন আগে। জালকুড়ি বাসষ্ট্যান্ড থেকে বিআরটিসি বাসে উঠি ২জন। নিচে সিট না পেয়ে আমি চলে যাই দোতলা। তিনি বসেন নিচে। ইচ্ছে ছিলো ঢাকা গিয়ে ২জন কথা বলবো। কিন্তু মতিউর রহমান মুন্সি নেমে গেলেন টোলপ্লাজায়। তার সাথে আমার আর জীবিত দেখা হলো না। হঠাৎ করে তার মৃত্যুর খবরে আমি অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ি। আমার একজন অভিভাবককে আল্লাহ নিয়ে গেলেন। খালু, আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসীব করুন। আমার জন্য আপনার অবদান আজীবন মনে রাখবো।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক , প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক , ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)