গোলাম ইয়াজদানী খান মিনু ও তাঁর বিপ্লবী রাজনীতি

301
Minu-22

।। আবু হাসান টিপু ।।

১৯৫৯ সালে কিউবা বিপ্লবের মহা নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন ‘ আমি ৮২ জনকে নিয়ে বিপ্লব শুরু করি। তা যদি আমাকে আবার করতে হয়, তবে আমি ১০ বা ১৫ জনকে নিয়ে করব এবং সম্পুর্ণ বিশ্বাস নিয়ে করব। সংখ্যায় আপনি কত কম, সেটা কোনো বিষয় নয়, যদি আপনার বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনা থাকে’। ফিদেল কাস্ত্রোর এ উক্তিটির সাথে চরমভাবে একমত ছিলেন গোলাম ইয়াজদানী খান মিনু, বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনা থাকলে সংখ্যায় আপনি কত কম, সেটা যে কোনো বিষয় নয়; তিনি এই কঠিন সত্যের জীবন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন ২০০৭ সালে নারায়ণগঞ্জে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিকে সুসংগঠিত করার দায়িত্ব গ্রহন করার মধ্যো দিয়ে।

প্রয়াত এই বাম নেতা ১৯৬৫ সালে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। কিছু দিন পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হলে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রæপের সাথে যুক্ত থাকেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি পার্টি কর্মী হিসেবে পিকিংপন্থী অংশে থাকেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) বিভক্ত হয়। সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অপর অংশ আব্দুল হকের নেতৃত্বে  পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার আহবান জানান। কমরেড মিনু ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহার পক্ষে।

মুক্তিযুদ্ধের পর সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহা সাম্যবাদী দল গঠন করলে কমরেড মিনু সাম্যবাদী দলের সাথে যুক্ত হন। এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে কমিউনিস্ট লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হন। ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টি (অমল সেন) ঐক্যবদ্ধ হলে গঠিত হয় ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। এরপর ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন হলে কমরেড মিনু ওয়ার্কার্স পার্টি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এবং একই সময়ে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির লেজুড়বৃত্তির সুবিধাবাদী নেতৃত্ব যখন মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামের কথা বলে পার্টিকে আওয়ামী লীগের লেজুড়ে পরিণত করলো, যখন বাম ফ্রন্ট ও ১১ দলকে ছত্রভঙ্গ করে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের লক্ষ্যে তথাকথিত ২৩ দফার ভিত্তিতে প্রথমে ১৪ দলীয় জোট ও পরবর্তীতে স্বৈরতন্ত্রী এরশাদের জাতীয় পার্টি ও মৌলবাদী খেলাফত মজলিশসহ শাসকশ্রেণীর যাবতীয় জঞ্জালের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়ে ক্ষমতার ছিটেফোটা বখরা পাওয়ার মোহে মহাজোটে সামীল হয়ে নৌকায় উঠে বসার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো তখন অনিবার্যভাবেই পার্টি ও বামপন্থী আন্দোলনের এই অন্তর্ঘাতমূলক বিলোপবাদী প্রবণতা ও ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পার্টি ও বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলন পুনর্গঠন ও বিকশিত করার কাজকে এগিয়ে নিতে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনের ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ ২০০৪ এর ১৪ জুন বিপ্লবী রাজনীতি ও বিপ্লবী সত্তা রক্ষায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারাদেশেই পার্টি পুনর্গঠনের যাত্রা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিপ্লবী ভাবমানস সম্পন্ন পার্টির নিবেদিত প্রাণ নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে নারায়ণগঞ্জেও গড়ে ঊঠে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন কমিটি) যা আজকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। নারায়ণগঞ্জে পার্টি গড়ে তোলার এ পর্যায়ের অন্যতম সিপাহশালার ছিলেন কমরেড মিনু।

কতিপয় বিপথগামী নেতৃত্বের কারণে নারায়ণগঞ্জ জেলা পার্টির চরম নিদান সৃষ্টি হলে ২০০৮ সালে কমরেড মিনু বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহন করেন। এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত সভাপতি হিসাবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বয়সের কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তিনি গত কয়েক বছর ধরে সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

সরল প্রাণ এই প্রচার বিমূখ বিপ্লবী জননেতা কমরেড মিনু খুব ভালো করেই বিশ্বাস করতেন, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের অগ্রণী মতবাদ, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত¡ আত্মস্থ করতে না পারলে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি নিজ শ্রেণীর নেতৃত্ব করার ভ‚মিকা নিতে পারে না, সর্বহারা বিপ্লবের সংগঠক ও পরিচালকের ভ‚মিকা নিতে পারে না।

মার্কসবাদী- লেনিনবাদী তত্তে¡র শক্তি হল, ইহা পার্টিকে যে কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান দেয়; বর্তমান ঘটনাবলীর অন্তর্নিহিত স¤পর্ক বুঝিয়ে দেয়; ঘটনার গতি পূর্ব হতেই লক্ষ্য করা, এবং শুধু বর্তমানের ঘটনা কেমন ভাবে ও কোন দিকে বিকাশ পাচ্ছে তা নয়, ভবিষ্যতেও কেমন ভাবে ও কোন দিকে বিকাশ পাবে তা বুঝবার ক্ষমতা দেয়।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত¡ যে পার্টি আত্মস্থ করেছে, কেবল সেই পার্টিই পারে আত্মবিশ্বাসের জোরে অগ্রসর হতে, পারে শ্রমিকশ্রেণীকে এগিয়ে নিতে। অপরপক্ষে, যে পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত¡ আয়ত্ত করে নাই, সে পার্টি পথ হাতড়ে চলতে বাধ্য হয়, নিজের কাজে ভরসা হারিয়ে ফেলে এবং শ্রমিকশ্রেণীকে এগিয়ে নিতে অসমর্থ হয়।

আর তাই তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি বিপ্লবী ধারার মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টি গড়ে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রক্ত লাল পতাকা নিয়ে শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ব্যক্তিগত জীবন যাপন করেছেন সাধারণের চাইতেও সাধারণ মানুষের মতো। এই নির্লোভী সরল প্রাণ সাহসী মানুষটির প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।

লেখক (মতামতটি লেখকের নিজস্ব )
আবু হাসান টিপু.
পলিট ব্যুরোর সদস্য
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
কেন্দ্রীয় কমিটি।