তিতাস অফিস ঘেরাওর পর নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সংকট আরো বেড়েছে

276

*  গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন নীট শিল্প
*  গৃহিণীদের ত্রাহি অবস্থা,অনেক বাসায় দিনে রান্না হয় না

মুহা:ইউসুফ আল আজিজ :
নারায়ণগঞ্জবাসী গত প্রায় দেড় এক মাস ধরে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। ভুক্তভোগী মানুষ গ্যাস সংকটের কারনে ফুঁসে উঠে নারায়ণগঞ্জ তিতাস অফিস ঘোরাও ও স্মারকলিপি দেয়ার পর গ্যাস সংকট আরো বেড়েছে। আগে দিনের বেলায় নিভু নিভু গ্যাস পাওয়া গেলেও এখন দিনের বেলায় আবাসিক বাসা বাড়িতে কোন গ্যাসই থাকেনা । ফলে মানুষ দিন দিন গ্যাস সংকটের কারনে অতিষ্ঠ হয়েং পড়েছে। দফায় দফায় তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয় ঘেরাওসহ স্মারকলিপি দিলেও ভোগান্তি থেকে উত্তোরণ ঘটছে না। গ্যাস সংকটের কারনে শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষ করে নীট শিল্প ধবংসের পথে ।
নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে গত ১২ সেপ্টেম্বর অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র উদ্যোগে তিতাসের নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচি শেষে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মামুনার রশীদের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে একের পর এক স্মারকলিপি দিচ্ছেন। সর্বশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে চাষাঢ়ায় তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ।
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সভাপতি নূর উদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জে জ্বালানি গ্যাসের সংকট চলছে। সংকট সমাধানে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও কোনো উদ্যোগ নেই। তিতাস কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই গ্যাসের এই অবস্থা। তাদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আমরা তিতাসের কাছে আমাদের অভিযোগ জানানোর পর আরো গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবেক সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্যাসের দাবিতে শুধু অবস্থান ধর্মঘটই নয়, হরতালও ডাকব। আর সেই হরতালের নেতৃত্ব দেবে আমাদের মা-বোনেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের বাবুরাইল, পাক্কারোড, দেওভোগ আখড়া, পালপাড়া, ভূইয়ারবাগ, নন্দীপাড়া, আমলাপাড়া, গলাচিপা, কলেজ রোড, জামতলা, উত্তর চাষাঢ়া, মাসদাইর, মিশনপাড়া, খানপুর, মেট্রো হল, দক্ষিণ সস্তাপুর, সস্তাপুর, কাঠেরপুল ও তল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। এসব এলাকার মানুষ সময়মতো রান্না করতে পারছেন না।
শহরের গলাচিপা এলাকার বাসিন্দা কাজী ইসলাম মিয়া বলেন, আগে দিনের কোনো না কোনো সময় গ্যাস মিললেও এখন সারাদিনই পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বাসা থেকে না খেয়ে বের হতে হয়। দুপুরেও বাসায় গিয়ে খেতে পারি না। রাতেরটা খেতে হয় ১২টায়। কিন্তু মাস শেষে ঠিকই বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিল না দিলে আবার লাইন কেটে দেয়। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না।
শহরের দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা সকালে খেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। প্রতিদিনই বাইরে থেকে নাস্তা কিনতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলতে পারবো। সবসময় বাইরে থেকে নাস্তা কেনার সামর্থ্য নেই। খুব সীমিত আয়ে আমাদের দিন পার করতে হয়।
১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, আমাদের হয় গ্যাস দেয়া হোক না হয় গ্যাস বিল মওকুফ করে দেয়া হোক। কর্তৃপক্ষ যেহেতু সমস্যার কথা বলছে তাহলে অন্তত দিনে বা রাতে সময় নির্ধারণ করে দুই ঘণ্টা সময় করে গ্যাস দেয়া হোক। যাতে আমরা কোনো রকম খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি।
১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে টানবাজার, মিনা বাজার, নিমতলা, বংশাল, মÐলপাড়া, আর কে দাস রোড, ওল্ড ব্যাংক রোড, ছোট ভগবানগঞ্জ, নয়ামাটি, চেম্বার রোড, পুরাতন পালপাড়াসহ ওয়ার্ডের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে জনগণের রান্নার কাজে বিঘœ হওয়ায় পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কাশীপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজারের বাসিন্দা সোনিয়া দেওয়ান বলেন, “সারাদিন গ্যাস থাকে না। আগে কুপির মতো একটু জ্বলতো। তাতে টিপটিপ করে ভাতটা অন্তত ফুটতো। এখন তো তাও নাই। তিনি আরও বলেন, “যেই বাড়িতে কাজে যাই সেইখানেও গ্যাস নাই। একজনের বাড়িতে এলপি গ্যাস আর আরেকজনের স্টোভ দিয়ে রান্না করি। তাগো ট্যাকা আছে তারা পারে, আমগোর জীবন কষ্টের!”
এমপি শামীম ওসমানের চিঠি
এদিকে গ্যাস সঙ্কট নিরসনের দাবি জানিয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান। চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাসের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মামুনার রশিদ। তিনি বলেন, আমরা তার এ চিঠি গ্রহণ করে ইতিমধ্যে ঢাকায় হেড অফিসে পাঠিয়েছি। হেড অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বেশী ক্ষতিগ্রস্থ নীট শিল্প
এদিকে গ্যাসের সংকটে সদর উপজেলার বিসিক শিল্পনগরী, আদমজী ইপিজেডসহ বন্দর, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলার কয়েকশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি আয় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নেতারা।
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়িরা বলেন, “জুন মাস থেকে গ্যাসের সংকট শুরু হয়েছে। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই থাকার কথা। কারখানার মেশিন চালানোর জন্য অন্তত পাঁচ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা লাগে। কারখানাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ দেড় পিএসআই। গ্যাসের চাপ কম থাকায় নিজের ফতুল্লা ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিং মিলস নামে কারখানাটিতে ৬০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে । তারা বলেন, “বিদেশি ক্রেতাদের ঠিকমতো শিপমেন্ট দিতে পারছি না। এতে তারা আমাদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। আবার ব্যাংকের টাকাও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছি না।”
গার্মেন্টস ও ডাইং ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান বলেন, বিল দিচ্ছি গ্যাসের কিন্তু পাচ্ছি বাতাস। বাতাস দিয়ে তো আর ফ্যাক্টরি চালাতে পারব না। গত ২ মাসের তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্প ও বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ঘরের গৃহিণীদের এখন চলছে ত্রাহি অবস্থা। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকেরা।
নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম , এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নিটওয়্যার সেক্টর গ্যাস সংকটের কারণে। কখনো সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা অবধি প্রায়ই গ্যাস থাকে না। যেখানে আমাদের ১৫ পিএসআই সংযোগ নেওয়া সেখানে আমাদের ৭-১০ পিএসআই পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে। কিন্তু গত ২ মাস ধরে গ্যাসের যে চাপ পাওয়া যায় তা মাত্র ০.৫ থেকে ১ পিএসআই। এর ফলে আমাদের উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ রয়েছে। যার ফলে উৎপাদনে আগামী মাসে বড় ধরনের ধস নামবে। ফ্যাক্টরিতে ডাইং থেকে ফেব্রিক্স না আসার কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে একটা বড় ধরনের সংকটে পড়বে নিটওয়্যার সেক্টর। আমরা সরকারের কাছে বলেছি, রিজার্ভ থেকে ৩-৪ বিলিয়ন ডলার লোন দিতে এলএনজি আমদানির জন্য। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি আগামী ৬ মাসের মধ্যে রিজার্ভে তিনগুণ টাকা ফেরত দিব।
তিতাসের নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মামুনার রশীদ বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ঠিক রাখতে বেশি গ্যাস দিতে হচ্ছে। এটা শুধু নারায়ণগঞ্জে নয় পুরো দেশের একই অবস্থা। আমরা দ্রæত এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জে মানুষের কাছে আহ্বান থাকবে আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরুন। সরকারকে সহায়তা করুন। আশা করি খুব শিগগিরই এ সংকট কাটিয়ে উঠবো।
তিনি বলেন,সিস্টেম থেকে গ্যাস সাপ্লাই কম আসছে। গত অগাস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সাপ্লাই এসেছে এই জেলায়। কিন্তু চাহিদা তিন মিলিয়ন কিউবিক মিটারেরও উপরে। তার উপর বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে গ্রাহক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারছি না।
গ্যাসের সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, সংকট নিরসনে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে জ্বালানি গ্যাসের এ সংকট থাকবে না। তবে আগামী কয়েক মাস অর্থাৎ শীতকাল পর্যন্ত গ্যাসের এ সংকট থাকবে বলে জানান তিনি।