নামে-বেনামে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ঋন নিয়েছে ব্যাংক মালিকরা

586

 

মিরর বাংলাদেশ: বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, ব্যাংকের মালিকরা নিজেদেরকে নিজেরা ঋণ দিচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিজেরা ঋণ নিয়েছেন। এটা অফিশিয়াল হিসাব। এর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা নামে-বেনামে এর সমপরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছেন। সবটা হিসাবের আওতায় আনলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) যৌথ উদ্যোগে ‘দ্য ম্যাক্রো ইকোনমি অ্যান্ড এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’ বিষয়ক এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন। ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাহিদী সাত্তার ও পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক মালিকরা ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখা তাদের দায়িত্ব বলে মনে করছেন না। তারা নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন। এই টাকা নিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে আরও বড় করছেন এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায় ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও বলেন, এক ব্যাংকের মালিক আরেক ব্যাংকের মালিককে ঋণ দিচ্ছেন। এটা আইনিভাবে সিদ্ধ। গ্রাহকের টাকা তারা নিজেরা ব্যবহার করছেন। একজন মালিক তার ব্যাংক থেকে অন্য পাঁচ ব্যাংকের পাঁচ জন পরিচালককে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছেন। আবার ওই পাঁচ ব্যাংক থেকে তিনি নিজেও আরও ৫ হাজার কেটি টাকা ঋণ নিচ্ছেন। কোনো মালিকই এই টাকা শোধ করছেন না। কেউ কাউকে চাপও দিচ্ছেন না। ফলে জনগণের জন্য ব্যাংক লাভজনক না হলেও ব্যাংক মালিকদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দশমিক ৫০ শতাংশ হলেও আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ। আমি এই ক্ষেত্রে গভর্নরের হিসাবের দিকে যাব না। কারণ ওই হিসাব আর্টিফিশিয়াল। কয়েক মাস আগেও খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশের বেশি থাকলেও বর্তমানে তা ৯ দশমিক ২ শতাংশ বলা হচ্ছে। এভাবে ব্যাংকের মন্দ ঋণ রিশিডিউল করলে আমি খেলাপি ঋণের পরিমাণ শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি। এতে ব্যাংক খাতে কোনো ক্যাশ ফ্লো আসবে না। ব্যাংকের আমানত-ঋণে ছয়-নয় শতাংশ সুদের কারণে এসএমই খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে এবং দেশে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ কমে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে আগের ৪৮ বছরের সমপরিমাণ ঋণ। আর এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও একদিকে সুবিধাই হবে। কারণ সরকারকে ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার অশঙ্কা থাকে না। কারণ সরকার ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সাড়ে ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।

পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, এনবিআরকে বর্তমান অবস্থায় রেখে সরকারের পক্ষে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এসডিজি‘র সঠিক বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও দিয়ে কোনো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে চলা সম্ভব হবে না।

সরকারকে ব্যাংক ঋণের বদলে রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণে সরকার ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে। এভাবে আরও দুয়েক বছর চলা সম্ভব। তবে এ বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। সরকারের প্রশাসনিক খাতসহ সব খাতে ব্যয় বেড়েছে। তাই সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, ব্যয় কমাতে হবে, সরকারের বিভিন্ন খাতে অপচয় রোধ করতে হবে। এগুলো করা সম্ভব না হলে অচিরেই দেশে একটা অচলাবস্থা দেখা দিতে বেশি দিন লাগবে না। আর সেটি হলে সরকারের নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আজ হোক আর কাল হোক, সরকারকে কঠিন অবস্থা মোকাবিলা করতে হবে। আমার মনে হয় সেই সময়টা বেশি দূরে নয়।