অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারীকে ভারত গ্রহণ করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত অতিক্রম করছে- উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও ৫০তম বছরে পা রেখেছে। তিনি এ সম্পর্কে আরো বলেন, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। মাত্র কয়েক মাস আগে, আপনাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী আমরা উদযাপন শেষ করেছি। বাংলাদেশে আমরা বাপুজির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে একটি বিশেষ ডাকটিকিট অবমুক্ত করেছি। আমরা আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাকবিভাগের একটি স্ট্যাম্পের উদ্বোধন করছি। এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো যৌথভাবে উদযাপনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হওয়ায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার এবং জনগণের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ, মুক্তি এবং উদযাপনের চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তিনি এই মাহেন্দ্রক্ষণে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর দিনটিকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, আজকের দিনটি আমার জন্য একটি বিশেষ দিন। ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধীনে তখনো আমার মা, ছোট বোন রেহানা, রাসেল এবং ছোট্ট ৪ মাসের শিশু পুত্র জয়সহ আমরা বন্দি ছিলাম। ভারতের কর্নেল অশোক তারা (তৎকালীন মেজর) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্ত করেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হলেও আমরা মুক্ত হয়েছিলাম ১৭ই ডিসেম্বর। আজকেই সেই দিনটি। তিনি বলেন, আমি কর্নেল অশোক তারার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। সেই সাথে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী সবার প্রতিই আমার ধন্যবাদ। শেখ হাসিনা ভারতের মতো জনবহুল দেশে কার্যকরভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত ও জনবহুল অঞ্চলে কোভিড-১৯ যেভাবে আপনার সরকার মোকাবিলা করেছে তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজগুলো ছাড়াও, ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর উদ্যোগে প্রবর্তিত অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলো প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আপনার গৃহীত নীতিমালার মাধ্যমে ভারত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শেখ হাসিনা আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান।
মোদি যা বললেন: ওদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সকল ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করাকে আমি অগ্রাধিকার দিয়েছি। এ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আত্মত্যাগকারী সবার প্রতি তিনি শ্রদ্ধা জানান। তিনি ২০২১ সালের ২৬শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বলেন, আগামী বছর বাংলাদেশ সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাওয়া আমার জন্য সম্মানজনক।
পারস্পরিক সহযোগিতার ৭টি সমঝোতা স্মারক সই: বাণিজ্য, জ্বালানি, কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতায় ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ এবং ভারত। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল সকালে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা সম্পর্কিত এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের কিছু সময় আগে দুই দেশের মধ্যে এসব চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে নিজ নিজ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তারা এবং ভারতের পক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী চুক্তিগুলোতে স্বাক্ষর করেন। দুই দেশের মধ্যে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিইও ফোরাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাইড্রোকার্বন বিষয়ে সহযোগিতা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও ভারতের জাতীয় জাদুঘর মধ্যে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও বরিশালের স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি। এই সমঝোতা চুক্তির আওতায়, বরিশালের লামছড়ি অঞ্চলে পয়ঃনিষ্কাশন কার্যক্রমে সরঞ্জাম সরবরাহ করবে ভারত। প্রথম চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের সিওও ফোরাম গঠনে স্বাক্ষর করেন বাণিজ্য সচিব মোহাম্মদ জাফর উদ্দিন এবং ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। সমঝোতা চুক্তির আওতায় কৃষি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশ। এছাড়াও হাইড্রোকার্বন খাতে, ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশে জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একেএম ফজলুল হক। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ হোসেন ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন। পরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চ্যুয়াল সামিটে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত থেকে পশ্চিমঙ্গের হলদিবাড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করা হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাকবিভাগের একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত এবং ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল এক্সিবিশনে’র উদ্বোধন করেন।
কোভিড-১৯ সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে নীরবে-ভারতের হাইকমিশনার: ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। এটি বরাবরই স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভার্চ্যুয়াল সামিটের পর বারিধারাস্থ চ্যান্সারি কমপ্লেক্সে স্বল্পসংখ্যক গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে আলাপে হাইকমিশনার এ মন্তব্য করেন। হাইকমিশনার বিক্রম বলেন, দিল্লির কাছে ঢাকা যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সে বার্তাটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, আমরা ঘোষণা না দিলেও কয়েক মাস ধরে নীরবে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মরিশাসের সঙ্গে নিজেদের সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতার চর্চা নিয়ে আলোচনা করে চলেছি। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, মিয়ানমারের বিতাড়িত লোকজনের জন্য যে সুবিধা তৈরি করা হয়েছে সেখানে তাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত। ভাসানচরের ছবি দেখে মনে হয়েছে নৌবাহিনী অসাধারণ অবকাঠামো তৈরি করেছে। কাজেই সুযোগ-সুবিধা যেখানে ভালো, শিবিরে রাখার চেয়ে তাদের লোকজনকে সেখানে সরিয়ে নেয়াই তো তুলনামূলকভাবে ভালো।’
ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে যুক্ত হতে আগ্রহী বাংলাদেশ: ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল সামিটে ত্রিদেশীয় এই মহাসড়কে ঢাকার আগ্রহের কথা জানিয়ে ভারতের সমর্থন চেয়েছেন তিনি। সামিট পরবর্তী যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, তিনি (শেখ হাসিনা) নির্মাণাধীন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্পের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত হতে ভারতের সমর্থন চেয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ (হিলি) থেকে মেঘালয় (মহেন্দ্রগঞ্জ) পর্যন্ত যোগাযোগের অনুমতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে। শেখ হাসিনা ও মোদি চলমান দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বাণিজ্য প্রটোকল (পিআইডব্লিউটিটি)-এর অধীনে দ্বিতীয় সংযোজন কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ভারতের পণ্য পরিবহনসহ সামপ্রতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের চালান দ্রুত পরিবহনে সম্মত হন। দুই দেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সহজ করতে তারা বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত- নেপাল (বিবিআইএন) যানবাহন চুক্তির সমঝোতা স্মারক দ্রুত সই করার বিষয়ে সম্মত হন। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে পণ্য ও যাত্রীদের চলাচল শুরু হলেও, ভুটান এতে পরে যোগ দিতে পারবে। এছাড়া, শিগগির স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। বিবৃতি মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত প্রায় ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেয়া এবং মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাদের নিরাপদ, দ্রুত ও স্থায়ী প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্য হওয়া ভারতকে অভিনন্দন জানান এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারতের সহায়ক ভূমিকা দেখার আশা ব্যক্ত করেন ।