বেঁধে দেয়া দামে এলপি গ্যাস মিলে না বাজারে

276

মিরর বাংলাদেশ : রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় নতুন ফ্ল্যাট উঠেন চাকরিজীবি রেজা রহিম । নুতন বাসা হওয়ায় তার বাসায় সরকারি লাইনের গ্যাস নেই। রান্নার কাজে সিলিন্ডার গ্যাসই (এলপিজি) ভরসা। গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় বুধবার তিনি দোকানে যান সিলিন্ডার কিনতে। ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন ১২০০ টাকায়। অথচ ১২ কেজি ওজনের একটি এলপিজি (এলপি গ্যাস) সিলিন্ডারের দাম মঙ্গলবার বিইআরসি নির্ধারণ করে দেয় মূসকসহ ১০৩৩ টাকা ।
তিনি বলেন, কয়েক মাস থেকে বাড়তি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। সরকার এলপিজির মূল্য বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব নেই। সবাইকে বেশি দামেই গ্যাস কিনতে হচ্ছে। কার্যকর করতে না পারলে এমন ঘোষণার দরকার কী?
শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে না। গত এপ্রিল মাস থেকে প্রতি মাসে এলপি (তরল পেট্রোলিয়াম) গ্যাসের দাম ঘোষণা করছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু গ্রাহককে বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিইআরসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তারা শুধু দাম ঘোষণাতেই দায় সারছে।
ক্রেতারা বলছেন, সরকারের দাম নির্ধারণ করে কী লাভ, বাজারে তো এই দামে গ্যাস মেলে না। অন্যদিকে বিইআরসি বলছে, সারাদেশে তদারকি করার মতো তাদের জনবল নেই। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হবে।
এলপিজির খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানি যে দামে তাদের কাছে গ্যাস বিক্রি করে তাতে কমিশন যোগ করলে সরকার ঘোষিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দেশের বাজারে পর পর ৩ মাস তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের বা এলপি গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো।
মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মূসকসহ প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৮২ টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮৬ টাকা শূন্য ৭ পয়সা নির্ধারণের ঘোষণা দেয় যা সেপ্টেম্বরজুড়ে কার্যকর থাকবে।
নতুন দাম অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ১২ কেজি ওজনের একটি এলপিজি (এলপি গ্যাস) সিলিন্ডারের দাম পড়বে মূসকসহ ১০৩৩ টাকা, যা অগাস্টে ৯৯৩ টাকা, জুলাইয়ে ৮৯১ টাকা, জুনে ৮৪২ টাকা এবং মে মাসে ৯০৬ টাকা ছিল।
বহুতল ভবন বা শিল্প কারখানায় কেন্দ্রীয়ভাবে বড় সিলিন্ডার স্থাপন করে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বা রেটিকুলেটেড সিস্টেমে সরবরাহ করা এলপিজির দাম ভোক্তা পর্যায়ে মূসকসহ প্রতি কেজি ৮৩ টাকা ৭৭ পয়সা করা হয়েছে, যা অগাস্ট মাসে ৮০ টাকা ৪৩ পয়সা এবং জুলাই মাসে ৭১ টাকা ৯৪ পয়সা ছিল।
এ ছাড়া অটোগ্যাস ভোক্তা পর্যায়ে মূসকসহ প্রতি লিটার ৫০ টাকা ৫৬ পয়সা করা হয়েছে, যা অগাস্টে ৪৮ টাকা ৭১ পয়সা এবং জুলাইয়ে ৪৪ টাকা ছিল।
সরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম আগের মতোই ৫৯১ টাকা রাখা হয়েছে। এই দামের সঙ্গে সৌদি সিপির সম্পর্ক না থাকায় মূল্য বাড়ায়নি কমিশন।
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সৌদি আরমকো কোম্পানির প্রোপেন ও বিউটেনের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসে এলপিজির নুতন দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি।
কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল লেন, আগস্ট মাসে সৌদি আরামকো কর্তৃক প্রোপেন ও বিউটেনের ঘোষিত সৌদি সিপির দাম যথাক্রমে প্রতি মেট্রিক টন ৬৬০ ডলার এবং ৬৫৫ ডলার হয়েছে। এ অনুযায়ী আগস্ট মাসে প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রণ অনুপাত ৩৫:৬৫ বিবেচনায় প্রোপেন ও বিউটেনের গড় সৌদি সিপি প্রতি মেট্রিক টন ৬৫৬ দশমিক ৭৫ ডলার (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা) বিবেচনা করে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ দাম কার্যকর হবে।
বিইআরসির নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে সাড়ে ৫ কেজি সিলিন্ডার ৪৭৩ টাকা, সাড়ে ১২ কেজি ১০৭৬ টাকা, ১৫ কেজি ১২৯১ টাকা, ১৬ কেজি ১৩৭৭ টাকা, ১৮ কেজি ১৫৪৯ টাকা, ২০ কেজি ১৭২২ টাকা, ২২ কেজি ১৮৯৩ টাকা, ২৫ কেজি ২১৫১ টাকা, ৩০ কেজি ২৫৮৩ টাকা, ৩৩ কেজি ২৮৪১ টাকা, ৩৫ কেজি ৩০১৩ টাকা এবং ৪৫ কেজি ৩৮৭৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিইআরসির আদেশে দেখা যায়, প্রোপেন-বিউটেনের মিশ্রণমূল্য পরিবর্তন হলেও রিটেইল চার্জ, ডিস্ট্রিবিউটর চার্জ, পরিবহন চার্জ, মূসক, মজুদকরণ চার্জ অপরিবর্তিত রয়েছে।
গ্যাস সংকটের কারণে দীর্ঘদিন আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বন্ধ থাকায় এলপি গ্যাসের বাজার বৃদ্ধি পায়। তবে সীমিত সরকারি উৎপাদনের কারণে বাজার চলে যায় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। অযৌক্তিকভাবে এলপিজির দাম বাড়তে থাকায় ভোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়েন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি খাতের এলপিজির দাম নির্ধারণের ঘোষণা দেয় কমিশন। সাধারণত সৌদি সিপি (কন্ট্রাক্ট প্রাইস) অনুযায়ী দেশে এলপিজির দাম নির্ধারিত হয়। প্রতি মাসের শেষে যখন সৌদি সিপির দাম পরিবর্তন হয়, তখন কমিশন এলপিজির দাম পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন করে আদেশ দেয়।
তবে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এর দাবি বিইআরসির নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা নতুন করে দাম নির্ধারণের জন্য কমিশনের কাছে আবেদনও করেছিল। প্রথমে করোনার কারণে এ-সংক্রান্ত শুনানি পিছিয়ে পড়ে। পরে উচ্চ আদলতে রিটের কারণে শুনানি স্থগিত হয়।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিইআরসির ভূমিকাটা কাগজেই থাকছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে গ্রহাকদের সঙ্গে নিয়ে কমিশনকে আরও শক্তিশালী হতে হবে।