বেড়েছে ধর্ষণ,কোথায় নিরাপদে নারী?

660

* ৮ মাসে ধর্ষণের শিকার ৮৮৯

মিরর   বাংলাদেশ : করোনা মহামরির ভয়াবহতার মধ্যেও দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বিশ^ময় কোভিড-১৯ আতঙ্কে দেশের মানুষ যখন নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত; সেসময়েও নারী-শিশুরা নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। নরপিশাচদের যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার মানসিকতা থেমে নেই। ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে বেড়েছে চরম উদ্বেগ। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার, সজন ও সহপাঠিরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।
সিলেটের এমসি কলেজে শুক্রবার সন্ধ্যার পর স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই ঘটনায় অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী। রোববার সাভারে স্কুলছাত্রী নিলাকে ভাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। দুই দিন আগে খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। রাজধানীতে স্বামীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। বাসা থেকে বের হয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আরেক গৃহবধূ। কুমিল্লায় বাসের ভেতর দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে আরেক তরুণীকে। এছাড়াও সম্প্রতি দেশের বিভিন্নস্থানে এমন আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ছয় বছর ও ১৩ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। যদিও কয়েকটি ঘটনায় অভিযুক্ত আসামেিদর গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মীদের ধর্ষণের শিকার তরুণী : শুক্রবার সন্ধ্যার পর স্বামীর সঙ্গে সিলেটের এমসি কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলেন এক তরুণী। সেখানেই কয়েক যুবক স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে সিলেট নগরীর শাহপরাণ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ছাত্রলীগের ছয় কর্মী ও অজ্ঞাত তিনজনকে আসামী করা হয়েছে।  আসামীরা হলেন-এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাছুম, রবিউল হাসান, তারেক আহমদ ও অর্জুন। এ ঘটনায় পুলিশ গতকাল প্রধান আসামীসহ দুই জনকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে, এই ধর্ষণের ঘটনার পর এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ‘ছাত্রলীগের দখলে’ থাকা হিসেবে পরিচিত একটি কক্ষে অভিযান চালিয়ে পুলিশ একটি পাইপগান, চারটি রামদা ও দুটি লোহার পাইপ উদ্ধার করে। কক্ষটি ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী সাইফুর রহমানের। পরে তার নামে অস্ত্র আইনেও আরেকটি মামলা হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন সিলেটের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
সাভারে ধর্ষণের পর স্কুলছাত্রী নীলা হত্যা : সাভারে গত রোববার রাত ৮টার দিকে ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া নীলা রায়কে ভাই অলক রায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালপাড়া মহল্লার একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাহত করে হত্যা করে স্থানীয় বখাটে মিজানুর রহামন চৌধুরী। নীলার পরিবারের দাবি, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নীলাকে হত্যা করে মিজানুর। সে স্থানীয় একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের রাজফুলবাড়িয়ার কর্নেল ব্রিকস ফিল্ডের পাশে অভিযান পরিচালনা করে প্রধান আসামী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় মিজানের দুই সহযোগী সাকিব ও জয়কে আটকসহ আলামত হিসেবে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি ছুরিও জব্দ করা হয় বলে পুলিশ জানায়। পরে ওই দুজনকেও গ্রেফতার দেখানো হয়। নীলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মিজান ও তার মা-বাবাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল মিজানের মা-বাবাকে দুদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। এরআগে মিজানুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবিতে ২৩টি সংগঠন আন্দোলনে নামার হওমকি দেয়।
খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণ: খাগড়াছড়িতে গত বুধবার রাতে এক আদিবাসী পরিবারের বাড়ির দরজা ভেঙে গৃহকর্তা, তার স্ত্রী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের হাত-মুখ বেঁধে ফেলে দুর্বৃত্তরা। পরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে পাশের রুমে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। এসময় বাড়ির আলমারি থেকে তিন ভরি স্বর্ণ, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন লুট করে নিয়ে যায় তারা। পরদিন সকালে গৃহকর্ত্রীর চিৎকারে স্থানীয়রা এসে তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারীর মা বাদী হয়ে অজ্ঞাত নয়জনকে আসামী করে মামলা করেন।  শুক্রবার জেলা সদরে মানবন্ধন করেছেন সাধারণ মানুষও। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বাসের ভেতরে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার এক তরুণী (১৬) গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে তিশা প্লাস পরিবহনের একটি বাসযোগে কুমিল্লা শহরের শাসনগাছার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। ওই তরুণী বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে শাসনগাছা বাস স্টেশনে তাকে না নামিয়ে কৌশলে বাসটি জেলা সদরের অদূরে সদর দক্ষিণ থানাধীন পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডের আল-শাকিল হোটেলের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে ভোররাতে খালি বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে ওই তরুণীকে হেলপার বাবু শেখ, চালক আরিফ হোসেন সোহেল ও সুপারভাইজার আলম মিলে ধর্ষণ করে। পরে ওই তরুণীকে পদুয়ার বাজার এলাকায় বাবু শেখের বসতঘরে নিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করা হয়। সকাল ৬টার দিকে অসুস্থ অবস্থায় তরুণীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেন তারা। এ ঘটনার পরে ভিকটিমের মা বাদী হয়ে ওইদিন রাতেই তিনজনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন।
গাইবান্ধায় দুই দিন ধরে তরুণীকে ধর্ষণ: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে (২০) দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বুধবার ফরিদপুর থেকে গোবিন্দগঞ্জে আসেন ওই তরুণী। এ সময় কয়েকজন যুবক তাকে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। সেখানে দুই দিন আটকে থাকার পর শুক্রবার কৌশলে পালিয়ে ওই তরুণী সরাসরি গোবিন্দগঞ্জ থানায় উপস্থিত হন। তার কথা শুনে অভিযান শুরু করে পুলিশ। পরে শাহাদৎ হোসেন (২০), জহুরুল সরকার (২৬), জাহাঙ্গীর মিয়া (৩৫) ও জাহিদ হাসান (২৭) নামে চারজনকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৪) ধর্ষণ করেছে তার ‘প্রাইভেট শিক্ষক’ মাজহারুল ইসলাম রায়হান। গত শুক্রবার ছাত্রীর বাবা-মা বাসার বাইরে থাকার সুযোগে প্রাইভেট পড়াতে এসে ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন তিনি। বাবা-মা বাড়িতে ফিরলে ওই ছাত্রী বিষয়টি তাদের জানায়।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ জন। সেই হিসেবে চলতি বছর প্রতিমাসে গড়ে ১১১ জন নারী  ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ  তথ্য জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)।

সম্প্রতি সংস্থাটির দেয়া এ পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। এছাড়া ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনার বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বাড়ছে। এর পাশাপাশি মূল্যবোধ, বিচারকার্যে রাজনৈতিক প্রভাব, নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ও এর জন্য দায়ী। এছাড়া যৌন বিষয়ক শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আকাশ-সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী বিস্তার এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। রয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহারও।

আসকের আইনি সহায়তাকারী এডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলী গণমাধ্যমকে জানান, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিচার হয় না। আর বিচার না হলে এমন ঘটনা বাড়বেই। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিচার হতে ৮ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতা তো রয়েছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচারকার্যে রাজনৈতিক প্রভাবও। সব মিলিয়ে বিচারহীনতার কারণে বেড়েই চলছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।