মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারে চলছে অধিকাংশ যানবাহন

137

* অহরহ দূর্ঘনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ

মিরর বাংলাদেশ  : ঢাকার ধামরাইয়ে একটি মাইক্রোবাসে গ্যাস সরবরাহের সময় বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হন। এ ঘটনায় আরও একজন আহত হয়েছেন । দূর্ঘটনার সময় নিহত ব্যাক্তির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় আশপাশের বেশ কয়েকটি গাড়িরও ক্ষয়ক্ষতি হয়।  শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ধামরাইয়ের ঢুলিভিটা এলাকার এনএন্ডএন সিএনজি স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, নিহত ব্যক্তির নাম ফারুক হোসেন (৫০)। তিনি গ্যাস গ্রহণকারী মাইক্রোবাসের চালক ও মালিক। ধামরাইয়ের আগে গত ১৪ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর বাসে গ্যাস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। লক্ষ্মীপুর শহরের গ্রিন লাইফ সিএনজি ফিলিং স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মেঘনা ক্লাসিক নামের একটি যাত্রী বাহি বাসে এদূর্ঘটনা ঘটে।
শুধু ধামরাই আর লক্ষীপুরে নয়, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই ঘটছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরনের ঘটনা। এতে কলে নির্মমভাবে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দীর্ঘদিনের পুরাতন সিলিন্ডার ব্যবহার করায় গাড়িচালক ও ব্যবহারকারী নিজেই জানেন না তার গাড়িটি বিপজ্জনক বোমা হয়ে উঠেছে।’
খোজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে চলছে অধিকাংশ গণপরিবহন ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এসব যানবাহনে সিএনজির মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার যেন কোনো ব্যাপারই না। সবাই যেন এ ব্যাপারে উদাসীন। যানবাহনের মালিক কিংবা চালক কারো যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই বিষয়টি নিয়ে। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও সিএনজি চালিত গাড়ি বা সিএনজি স্টেশনে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটলেও পরবর্তী সময়ে সবাই ভুলেই যায়। শুধু ঢাকা শহরেই চলছে লাখ লাখ সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এছাড়া সিএনজি চালিত প্রাইভেটকার ও গণপরিবহনতো রয়েছেই।
গুলিস্তান সহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে কথা হয় পরিবহন চালকদের সঙ্গে। গাজীপুর পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০৬৯৬) গুলিস্তানগামী চালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ঝুঁকি নিয়েই পেটের দায়ে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাই। আমরা জানি গ্যাসচালিত গাড়ি যেকোনো মুহূর্তে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তারপরও মালিকরা গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিং করান না।’
তিনি বলেন, ‘এসব করতে দু-তিন দিন সময় লাগে। এ ছাড়া রিটেস্টিং করাতে গেলে ২০ থেকে ৪০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য দুই হাজার টাকা, ৪০ থেকে ৬০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য আড়াই হাজার টাকা, ৬০ থেকে ৮০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য ৩ হাজার টাকা এবং ৮০ লিটারের বেশি প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়। এ কারণে গাড়ির মালিকরা এ প্রক্রিয়াকে বাড়তি খরচ ও সময় নষ্ট বলে মনে করেন।’
রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) সূত্র জানায়, দেশে ৫ লাখ যানবাহনে সাড়ে ৫ লাখ সিলিন্ডার রয়েছে। এর বেশিরভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও পুনঃপরীক্ষা করাতে বেশিরভাগ মালিক বা চালকরা আসেন না। আর ট্রাকে যে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় তার পুরোটাই অবৈধ। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সিলিন্ডার ৫ বছর পর পরীক্ষা করানোর কথা থাকলেও সেটি করা হয় না। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএ যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ফিটনেস দেখভাল করলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
সূত্র মতে, দেশে পুনঃপরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১৩ থেকে ১৪টি। বিআরটিএ থেকে ফিটনেস নেওয়ার সময় যদি পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় তবে ঝুঁকি অনেকটা কমবে। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা সাড়ে ৩৮ লাখ। এর মধ্যে রাজধানীতে চলাচল করছে ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ১৯২টি। তবে রাজধানীসহ দেশে যানবাহনের বড় একটি অংশ সিএনজিচালিত। অথচ সিলিন্ডারের ফিটনেস পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও তা করা হচ্ছে না।
জ্বালানি বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৪ লাখ গ্যাস সিলিন্ডারের মধ্যে মাত্র ৫৩ হাজার ৮০০ সিলিন্ডারের রিটেস্টিং করা হয়েছে। মোট সিলিন্ডারের মধ্যে যা মাত্র ১৪ ভাগ। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮০টি সিএনজি কনভারশন ওয়ার্কশপ রয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে দেশে সিএনজিচালিত গাড়ির প্রচলন শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিএনজি সিলিন্ডারের প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৩২শ’ পাউন্ড চাপে গ্যাস ভরানো হয়। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার হলে যানবাহনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ প্রতিরোধে গ্যাস সিলিন্ডারের সঠিক মান রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। বাধ্যবাধকতা থাকার পরও সিএনজিচালিত যানবাহনে পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় চলাচল করছে বিপজ্জনক এসব যানবাহন। ঘন ঘন দুর্ঘটনা এড়াতে গ্যাস সিলিন্ডারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের প্রফেসর ড. শামসুল হক গনমাধ্যমকে বলেন, সিএনজি চালিত যানবাহনের বিষয়ে আরো বেশি দায়িত্বশীল তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমরা লক্ষ করি ঢাকায় যেসব সিএনজি পুরোনো হয়ে যায় এর অনেকগুলো আবার গ্রাম এলাকায় ব্যবহার করে এতেও কিন্তু ঝুঁকি রয়ে যায়। এগুলো ব্যবহারে ঝুঁকিতে ফেলেন সাধারণ মানুষকে। এসব নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কঠোর হয়ে কাজ করতে হবে। কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি করেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তা না করে টেকনিক্যাল লোকজন দিয়ে কাজ করাতে হবে। বড় দুর্ঘটনায় শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। না হলে তদন্ত থেমে যাবে।
বিস্ফোরক অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে , ‘সিলিন্ডারের মধ্যে এলপি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তারচেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি চাপ সহ্য করার সক্ষমতা রয়েছে মানসম্পন্ন সিলিন্ডারের। এ সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এটি ব্যবহারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। তবে মেয়াদের মধ্যে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো ঝুঁকি নেই বললেই চলে। সিলিন্ডার দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভ ইত্যাদিতে দুর্বলতার কারণে যেকোনো সময় গ্যাস লিক হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস সামান্য আগুন কিংবা স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। আর যথাযথভাবে সিলিন্ডার পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহার না করা এবং মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।