রান্নার গ্যাসে প্রতিমাসে ৩ রকম দাম পরিশোধ করছে গ্রাহক

274

*দাম বৈষম্যে হতাশা আর দীর্ঘ  মেয়াদী ক্ষোভ

* একই ভবনে বসবাস করে তিন রকম বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে

ইউসুফ আল আজিজ :

রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বৈষম্য নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে যেমন ক্ষোভ রয়েছে তেমনি রয়েছে নানা রকম বিড়ম্বনা। পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারী ( ডাবল চুলা) এক মাসে বিল পরিশোধ করে ৯৭৫ টাকা। একই সময়ে প্রিপেইড গ্রাহকের প্রতিমাসে নুন্যতম খরচ হয় মাত্র ৫শ টাকা । পাশপাশি একই গ্রাহক যদি এলপি গ্যাস ব্যবহার করেন তাহলে গুনতে হয় প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা। মাটির নিচের এই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সব জনগণের সমান অধিকার। তাহলে কেন দাম বৈষম্য । দীর্ঘ দিন ধরে এমন প্রশ্নের কোন উত্তর নেই মানুষের কাছে। বরং রয়েছে হতাশা আর দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষোভ।
জানা গেছে, একই সেবা নিতে একই শহরে থেকে তিনজন তিন রকম খরচ করছেন। আর এই তিনজনই তিন রকম খরচ করছেন ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে।যার বাড়িতে পাইপের গ্যাস আছে তিনি তো তা ব্যবহার করছেনই। ইচ্ছে করলেই তিনি প্রিপেইড মিটার নিতে পারবেন না। কারণ সব এলাকায় এটা যায়নি। পাইপ গ্যাস থাকলেও নির্ধারিত এলাকায় বসবাস না করায় মিটার লাগানোর সৌভাগ্য তার নেই। আর নতুন ভবন হলে যে সিলিন্ডারের বিকল্প নেই তা সবার জানা। ফলে ইচ্ছে পোষণের সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে বৈষম্যের শিকার । একই মহল্লায় পাশাপাশি বসবাস করে কেউ সস্তা গ্যাস দিয়ে রান্নাবান্না করছেন। আবার কেউ কেউ বেসরকারি উচ্চ মূল্যের গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এই তিন গ্রাহকের জন্যই দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। তাদের এই সব দামের মধ্যে সমন্বয় করার উদ্যোগ নেই।
জ্বালানি খাত নিয়ে লেখালেখি করছি ২৫ বছরের বেশি। অন্তত ২০ বছর ধরে শুনে আসছি, বাসাবাড়িতে গ্যাসের প্রচুর অপচয় হয়। আমলারা বলে আসছেন, গ্রাহকরা শীতকালে সারাদিন চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। অনেকে দিয়াশলাইয়ের একটি কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা নেভান না। এভাবে গ্যাসের অপচয় হয়। একই সঙ্গে তারা বারবার বলে আসছেন, এই অপচয় বন্ধ করতে প্রতিটি বাড়িতে প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিতে হবে। দিতে হবে প্রিপেইড কার্ড। কার্ডে টাকা ভরার পর গ্যাস খরচ করতে হবে। তখন সবাই গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবেন। কিন্তু গত ২৫ বছরে ১০ ভাগ বাসাবাড়িতেও প্রিপেইড মিটার চালু করা সম্ভব হয়নি। কেন এই প্রিপেইড মিটার সব গ্রাহককে দেওয়া গেল না- তার কোনো সদুত্তর নেই। সরকারি ৪৩ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ ৭৯ হাজার প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
সূত্র জানায়, সিলিন্ডার বা এলপিজির গ্রাহক ৪০ লাখ। ৯৯ শতাংশ এলপিজি বেসরকারি খাতে আমদানির পর সিলিন্ডারে ভরে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এলপিজি আমদানি করে থাকে দেশীয় ১৯-২০টি কোম্পানি। এ খাতে লাইসেন্স দেওয়া আছে ৪২টি। বড় কোম্পানির মধ্যে আছে ওমেরা, বসুন্ধরা ক্লিনহিট, যমুনা, বেক্সিমকো ইত্যাদি। এসব কোম্পানিই সারাদেশে সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। খুবই সামান্য পরিমাণ এলপিজি দেশে উৎপাদিত হয়। দেশীয় কয়েকটি গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাসের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ কনডেনসেট পাওয়া যায়। এই কনডেনসেট চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করে বেশ কয়েকটি বাই প্রডাক্ট পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০ হাজার টন এলপিজি উৎপাদন করা হয়। এই এলপিজি সিলিন্ডারে ভরে সরকারি একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। তবে এটা দেশে ব্যবহূত মোট এলপিজির মাত্র ২ শতাংশ।
সারাদেশে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী বিভাগসহ বিভিন্ন জেলায় পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে সরকারিভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস দেওয়া হয় না। এখানে পাইপলাইন নেটওয়ার্কও সম্পন্ন হয়নি। যেসব জেলায় নেটওয়ার্ক আছে, সেসব এলাকায়ও সব বাসাবাড়িতে গ্যাস দেওয়া হয় না।
পৃথিবীর অনেক শহরেই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। পাইপের মাধ্যমে গ্যাস দেওয়া হয় মূলত শিল্প কারখানায়। অনেক দেশে বিদ্যুতে অথবা সিলিন্ডার গ্যাসেই রান্না করা হয় বেশি। আমাদের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করতে চায়।
কিন্তু এলপি গ্যাসের মূল্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু এর মূল্য নয় নিরাপত্তাও শঙ্কীত করে রেখেছে অনেককে। অনেকের কাছে সিলিন্ডার মানে আতঙ্ক। ভয়। এজন্য পাগলের মত পাইপের গ্যাসের দিকে ঝোঁক।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার খিলগাও এলাকার একটি বাসায় আগে থেকেই পাইপলাইন গ্যাস সংযোগ আছে। বর্তমানে ডাবল চুলা ব্যবহার করে মাসে গ্যাসের বিল দেন ৯৭৫ টাকা। আপনি একজন পোষ্টপেইড গ্রাহক। আপনি যদি একজন প্রিপেইড গ্রাহক হন; অর্থাৎ মোবাইল রিচার্জের মত কার্ডে টাকা ভোরে গ্যাস ব্যবহার করেন। তবে সারা মাস ইচ্ছে মত রান্না করেও ৫০০ টাকার কম খরচ হয়। আবার আপনার ছাদের উপরে নতুন ফ্লাট, যেখানে আগে থেকে কোন গ্যাস সংযোগ ছিল না। এমন বাড়ি হলে সেখানে যারা বসবাস করছেন, তারা পাইপলাইন গ্যাসের সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে তাদের রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর এজন্য মাসে খরচ করতে হচ্ছে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা।
একই সেবা নিতে একই শহরে থেকে তিনজন তিন রকম খরচ করছেন। আর এই তিনজনই তিন রকম খরচ করছেন ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে।যার বাড়িতে পাইপের গ্যাস আছে তিনি তো তা ব্যবহার করছেনই। ইচ্ছে করলেই তিনি প্রিপেইড মিটার নিতে পারবেন না। কারণ সব এলাকায় এটা যায়নি। পাইপ গ্যাস থাকলেও নির্ধারিত এলাকায় বসবাস না করায় মিটার লাগানোর সৌভাগ্য তার নেই। আর নতুন ভবন হলে যে সিলিন্ডারের বিকল্প নেই তা সবার জানা। ফলে ইচ্ছে পোষণের সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে বৈষম্যের শিকার। গ্রাহকদের জন্য এ একটা বাড়তি আর্থিক চাপ, যা মেনে নেওয়া কঠিন