সবুজ গালিচায় মিশে থাকবেন ম্যারাডোনা

551

মিরর বাংলাদেশ :
সবুজ গালিচায় আর দেখা যাবে না ফুটবলের জীবন্ত রাজপুত্রকে। তবুও তার পায়ের তুলিতে আঁকা অসংখ্য মুহূর্ত ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতির পাতায় সাজানো থাকবে চিরকাল। ফুটবল রাজপুত্রের চির বিদায় পুরো বিশে^র পক্ষ-প্রতিপক্ষকে করে দিয়েছে এক। বুধবার তিগ্রে-তে নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। শোকের মাতম বইছে বিশ^জুড়ে।

কিছুদিন আগে বুয়েন্স আয়ার্সের হাসপাতালে তার মস্তিষ্কে জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়। মস্তিষ্কে জমাট বেঁধে থাকা রক্ত (ক্লট) অপসারণ করা হয়েছিল। তখন মাদকাসক্তি নিয়ে ভীষণ সমস্যায় ভুগেছেন ম্যারাডোনা। তাকে পুনর্বাসনের জন্য তাকে নেয়া হয়েছিল তিগ্রে-র একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। সেখান থেকে ফিরেছিলেন নিজ বাড়িতে। কে জানতো, পৃথিবীতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আর কয়েকটা দিন। মাত্র ৬০ বছর বয়সে কোটি ফুটবলভক্তকে কাঁদিয়ে অন্য পারের বাসিন্দা হলেন বাঁ পায়ের যাদুকর। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা করেছে আর্জেন্টিনা সরকার। বিশে^র সব ক্রীড়াঙ্গন, অ্যাথলেট, তারকা থেকে সর্বস্তরের মাঝে বিরাজ করছেন এই মহাতারকা। গত রাতে (আর্জেন্টিানার স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার) রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় কাসা রোসাদায় তাকে শেষ বিদায় জানানো হবে। করোনা মহামারিতে বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে অনুষ্ঠানটি।

আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) এক টুইট বার্তার খবরটি নিশ্চিত করেছে, ‘আমরা ভীষণ শোকার্ত আমাদের কিংবদন্তির মৃত্যুতে। আপনি সবসময় থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।’ তবে ম্যারাডোনার মৃত্যুর তারিখটিও অনেক কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে গণমানুষের কাছে। কারণ ২৫ নভেম্বর (বুধবার) মারা গিয়েছেন ম্যারাডোনা, ঠিক ২০১৬ সালের একই তারিখে (২৫ নভেম্বর) পর পারে পাড়ি দিয়েছেন তার বন্ধু সাবেক কিউবার প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রো।

অপরদিকে ম্যারাডোনা-পেলে সেরা কে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বাক-বিতণ্ডা হয়তো কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিন্তু বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে। ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর পেয়ে ইনস্টাগ্রাম লেখেন, ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর। প্রিয় বন্ধুকে হারালাম। অনেক কিছু বলার রয়েছে। কিন্তু এই দুঃসময়ে ঈশ্বর ওর পরিবারকে শক্তি দিন। আশা করি, এক দিন আকাশে ফুটবল খেলব আমরা।’

আর্জেন্টিনার জেতা সবশেষ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোর আসরে বলতে গেলে প্রায় একাই চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন লাতিন আমেরিকার দেশটিকে। ওই বিশ্বকাপেই ফুটবল বিশ্ব দেখেছিলেন তার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটি। ক্লাব ফুটবলে নাপোলিকে দিয়েছিলেন লিগ শিরোপার স্বাদ। ইতালিয়ান এই ক্লাবে যাওয়ার আগে খেলে গিয়েছিলেন বার্সেলোনার জার্সিতে। আর ক্যারিয়ারের শেষটা করেছিলেন বোকা জুনিয়র্সে।

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এই ফুটবল কিংবদন্তি আর্জেন্টিনার জার্সিতে ৯১ ম্যাচে করেছেন ৩৪ গোল। ১৯৯৭ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ৩৭ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানান ম্যারাডোনা। রেকর্ড বইয়ে তার নামের পাশে লেখা থাকল ৬৭৮ ম্যাচে ৩৪৫টা গোল। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। ২০০৮ সালে দায়িত্ব নিয়ে আলবিসেলেস্তেদের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছিলেন ২০১০ সালের বিশ্বকাপেও। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর্জেন্টাইন ক্লাব জিমনেসিয়ার কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে টুইট করে লিওনেল মেসি লিখেন, ‘আর্জেন্টিনা প্রতিটি মানুষ এবং ফুটবলের জন্য আজ অত্যন্ত দুঃখের দিন। দিয়েগো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের ছেড়ে কখনো যাবে না দিয়েগো। কারণ ও চিরন্তন। দিয়েগোর সাথেঞ যে সব সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছি, তা আমার স্মৃতিতেই থাকবে। দিয়েগোর পরিবার ও বন্ধুদের সমবেদনা জানাই।’

এই প্রজন্মের আরেক গ্রেট ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো টুইট করে লিখেছেন, ‘আজ আমি এক বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছি আর সারা বিশ্ব বিদায় জানাচ্ছে এক চিরকালীন প্রতিভাকে। সর্বকালের সেরা একজনকে, এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাদুকরকে। বড় তাড়াতাড়ি তাকে চলে যেতে হল, কিন্তু এক সীমানাহীন উত্তরাধিকারকে তিনি রেখে গেলেন। তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। হে শ্রেষ্ঠ, তুমি শান্তি লাভ কর। তোমাকে কখনো ভোলা যাবে না।’

এদিকে মার্শেই কোচ আন্দ্রে ভিয়াস-বোয়াস তো বললেন, ম্যারাডোনার পরা ১০ নম্বর জার্সি সব দলের জন্যই তুলে রাখা উচিৎ।

ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আজ আমাদের জন্য অবিশ^স্য একদিন। আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে দিয়েগো। আমাদের হৃদয় থেকে তার জন্য অসংখ্য ভালোবাসা। এই মুহূর্তে আমাদের নিরবতা, আমাদের ব্যাথা, আমাদের অশ্রু সব তুমি কেড়ে নিয়েছো। পর পারে ভালো থাকো দিয়েগো। আমরা তোমাকে ভালোবাসি।’

ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোকাহত বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনও। সামাকিজ যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা লিখেছেন, ‘শোকের পরে শোক চলছে। তোমার থেকে বড় সুপারস্টার আমার চোখে আর কেউ ছিল না, আর আসবেও না। ব্যক্তিজীবনে তুমি আমার একমাত্র সুপারস্টার ছিলে যাকে আমি একবার হলেও সামনে থেকে দেখতে চেয়েছিলাম। তোমার বাঁ-পায়ের আঁকা নিখুঁত গোলের ছবিগুলো মনের ক্যানভাসে থেকে যাবে আজীবন। ভালো থেকো ওপারে যাদুকর। দি ড্রিবলিং মাস্টার দিয়েগো আরমান্দো মারাডোনা।’

১৮ বছর বয়সে প্রথম ক্লদিয়া ভিল্লাফানেকে বিয়ে করেন তিনি। সেই সংসারে রয়েছে দুই কন্যা। পরে অবশ্য ২০ বছরের দাম্পত্য ভেঙে গিয়েছিল ২০০৪ সালে। তবে একাধিক বন্ধাবীর সাথে দেখা যায় তাকে। ধারণা করা হয় ১০ জনের অধিকা সন্তান রয়েছে তার। দারুণ ফুটবলে যেমন নন্দিত ছিলেন, তেমনটি নিন্দিতও ছিলেন বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণে। বিশেষ করে, কোকেন সেবন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ফুটবল ক্যারিয়ারে। যে কারণে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে দুই ম্যাচ পর নিষিদ্ধ হন কিংবদন্তি। ১৯৯১ সালে ড্রাগ পজিটিভ হয়ে ১৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি। তবে ম্যারাডোনাকে বিশ্ব মনে রাখবে তার অসম্ভব সুন্দর ফুটবল কারুকার্যের জন্য।