”৫ হাজার টাকার ঋনে ২ লাখ১০ হাজার টাকা পরিশোধ”
নিয়াজ মোহাম্মদ মাসুম নারায়ণগঞ্জ :
জীবিকার তাগিদে প্রায় ৪ বছর আগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরতলা থেকে স্বামী হান্নান চৌকিদারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন শ্রমিক রানী আক্তার । নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা আলীগঞ্জ এলাকায় ইট ভাঙার শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। আলীগঞ্জ পিডবিøউডি কলোনিতে বসবাস শুরু করেন তারা। ঐ কলোনির সুদের মহাজন মো. আজাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকেন তাঁরা । অভাবের তাড়না ২ বছর আগে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋন নেন আজাদের ছোট মেয়ে লাকি বেগমের কাছ থেকে।
শর্ত ছিল, ৫ হাজার টাকার ঋণের জন্য প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা সুদ গুনতে হবে। ঋণ শোধ না হলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে সেই টাকা। অর্থাৎ মাসিক ৮০ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিতে হবে। সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সুদসহ পুরো টাকার জন্য প্রতি মাসে আবার ৮০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। সুদের জালে আটকা পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন রানী ও হান্নান।
শুধু তাই নয় সুদের টাকা মেটাতে না পারায় রানী আক্তারের এক দিনের শিশু বাচ্চাকে অন্যত্র বিক্রি করে দেয় সুদখোর লাকী আক্তার। ঋনের টাকা শোধ না হওয়ায় স্ত্রী রানী আক্তারকে রেখে পালিয়ে যায় হান্নান চৌকিদার। এক বছর আগে বিক্রি করে দেয়া ঐ পুত্র শিশু সন্তানকে শনিবার রাতে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা এলাকার দক্ষিণ পাশা থেকে উদ্ধার করে ফতুল্লা থানা পুলিশ। এঘটনায় লাকী আক্তারের বাবা মা ও শিশুটি ক্রেতা রানু বেগমসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ । জিজ্ঞাসাবাদের পর রানু বেগম ছাড়া ৪ জনকে ছেড়ে দেয় হয়। তবে অভিযুক্ত লাকি আক্তার পলাতক রয়েছে।
শিশু সন্তানটির মা রানী আক্তারের অভিযোগ, দুই বছর আগে লাকির কাছ থেকে স্বামীর নেওয়া মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঋণের সুদ হিসাবে এ পর্যন্ত ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। তারপরও আরও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওনা বলে দাবি করছেন লাকি। টাকা শোধ করতে না পারায় ১ বছর আগে জন্ম নেওয়া তাঁর একদিন বয়সী নবজাতককে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ঋণ শোধ না হলে মারধরের ভয়ে রানীকে রেখে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালিয়েছেন তাঁর স্বামী।
সুদের জালে আটকা পড়ে নিজের সন্তানকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কাঁদেন রানী। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাঁকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়া হয়েছে। রানী বলেন, ‘গর্ভে সন্তান আসার পর ওরে পেটে নিয়াই কাজ করছি। সেই সন্তান যখন জন্ম নিল তখন আমারে না জানাইয়া একদিন বয়সী ছেলেরে বেইচা দিসে। কোথায় কার কাছে বিক্রি করসে আমি তা জানি না। আমি যখন ছেলে বেচার কারণ জানতে চাইলাম তখন লাকি বলল সুদের টেকা না দেওয়ায় ছেলেটারে বেইচা দিসে। তা ছাড়া বাচ্চা থাকলে আমার কাজ করতে সমস্যা। আর ঠিকঠাক কাজ না করা গেলে সুদের বাকি টাকা ফেরত দিতে সমস্যা হইব।’
রানীর অভিযোগ, তিনি পড়াশোনা জানেন না। শহরে পরিচিত কেউ নেই। এই সুযোগেই লাকি বেগম ও তার স্বামী হজরত আলী ঋণ বাবদ তাঁর কাছ থেকে কাগজে সই রেখেছে। সেই কাগজ দেখিয়ে থানায় মামলা করা যাবে, পালিয়ে গেলেও পুলিশ দিয়ে ধরে আনা হবে এমন ভয় দেখানো হয়েছে তাঁকে। ফলে সন্তান বিক্রির বিষয়ে জানাতে তিনি পুলিশের কাছে যাননি। উল্টো ইট ভেঙে যে আয় হয়েছে তা দিয়ে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দিনের পর দিন ঋণ কেবল বেড়েছে। টাকা শোধ করতে না পেরে আয়ার কাজ করেছেন লাকি বেগমের বাড়িতে।
লাকি আক্তারের বাবা মো. আজাদ বলেন, তাঁরা কোনো সুদের কারবার করেন না। এগুলো তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তবে তাঁর মেয়ে লাকি বেগম দিনমজুর রানী বেগমকে সুদে টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি জানান, বাচ্চা বিক্রি করে সুদের টাকা আদায়ের বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
শিশুটি ক্রয় কারী আটককৃত রানু বেগম জানায়,তার একটি ছেলে ও মেয়ে রয়েছে।কিন্ত ছেলেটি প্রতিবন্ধী। তাই সে একটি ছেলে দত্তক বা ক্রয় করার জন্য পরিচিতজনদের বলে রেখেছিলো। এক বছর একমাস পূর্বে শ্যামপুর আফসার করিম রোডের মৃত আয়াত আলীর স্ত্রী সুমা তাকে ফোন করে জানায় একটি বাচ্চা বিক্রি হবে।সে তখন ৬০ হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চাটি ক্রয় করে। বাচ্চাটির নাম রেখেছেন ইউসুফ।
সুমা জানায়,তার বোন ঝর্নার মাধ্যমে জানতে পারে যে একটি বাচ্চা বিক্রি হবে।পরে সে তার মামী রানু বেগম কে জানালে সে আগ্রহ প্রকাশ করে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চাটি কিনে নেয় অপরদিকে ঝর্না জানায়, আলীগঞ্জস্থ বিডবিøউটি কলোনীর শাহালমের ভাড়াটিয়া ফারুকের স্ত্রী রুবিনা তাকে ফোন করে জানায় বাচ্চা বিক্রির কথা।
রুবিনা জানায়, লাকী বেগম তাকে বাচ্চা বিক্রির কথা জানায়।পরে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাচ্চাটি কিনে নেয় রানু বেগম। লাকী টাকা নেয় এবং বাচ্চাটিকে তার মা নিজেই রানু বেগমের হাতে তুলে দেয়।
ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তরিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগ পেয়ে তদন্ত নেমে নিজস্ব সোর্স ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শনিবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার দক্ষিণ পাশা গ্রামে অভিযান চালিয়ে বাচ্চাটি কে উদ্ধার সহ আটক করা হয়েছে রানু বেগমকে।
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান জানান, অভিযোগের ভিত্তিতে পিডবিøউডি কলোনি এলাকাতে লাকি বেগমকে পাওয়া না গেলেও তার মা, বাবা ও প্রতিবেশী এক নারীকে (দাই) থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শিশু উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
##