মিরর বাংলাদেশ: শত্রুতার কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। ওর লাশের সঙ্গে মানিব্যাগ, বøুট্রুথ, অকোজো মোবাইল, ঘড়ি সব-ই পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। তিনিও সন্তানের মা, তিনি বোঝেন, সন্তান হারালে কীভাবে একটা পরিবারের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মেধাবী ছাত্রদের এভাবে মেরে ফেললে দেশের ভবিষ্যত কি দাঁড়াবে ? ২৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন আমার, আজ হত্যাকান্ডের শিকার।’
ছেলেকে হারিয়ে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা জানান বুয়েটের ছাত্র ফারদিন নূর পরশের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ছেলের লাশ সামনে নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। পরশের বাবা জানান, শুক্রবার রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তারা ছেলেকে খোজাঁখুজি শুরু করেন। শনিবার রামপুরা থানায় জিডি করেন, পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছিল।
সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের লক্ষীনারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর একজন ছেলে বন্ধু ও এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন গত শনিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
ফারদিনের বাবা বলেন, শনিবার ছেলের টার্ম পরীক্ষা ছিল বুয়েটে, সেজন্য সে শুক্রবার দুপুরে বাসা থেকে বের হয়েছিল। ওইদিন রাত ১১টা পর থেকে ছেলের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার সে যখন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি তখন ছেলের বন্ধু ও শিক্ষকরা বাসায় ফোন দেয়। তারপর থেকে আমরা ছেলেকে খোঁজাখুজি শুরু করলাম। না পেয়ে থানায় নিখোঁজের জিডি করলাম। পরে জানতে পারলাম, শুক্রবার রামপুরা থানা এলাকায় পরশ তার এক বান্ধবীকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। আমার ছেলে কোন রাজনীতি সাথে সম্পৃক্ত ছিলো না।
পরশকে নিয়ে বাবা নূর উদ্দিন আরও বলেন, পরশ রুটিন ধরে পড়াশুনা করত, পড়ালেখায় অনেক মনযোগী ছিলো। সে বুয়েট, ঢাবিসহ তিন জায়গায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। পরে সে বুয়েটে ভর্তি হয় কিন্তু হলে যায়নি। এর কিছুদিন পর আবরাব হত্যাকা- ঘটে। এরপর ছেলে আর হলে যেতে চাইনি, আমরাও যেতে বলেনি। বাসা থেকে লেখাপড়া করত, বুয়েটের ক্যাম্পাসে যেত। খুব প্রয়োজন হলে বুয়েটের হলে থাকতো পরশ। যে ভয়ে ছেলেকে বুয়েটের হলে আমরাও যেতে বলিনি আজ সেটাই সত্যি হলো।
নূর উদ্দিন বলেন, এভাবে যদি আমরা এক একটা মেধাবি ছাত্র হারাতে থাকি, তাহলে ভবিষ্যত কি হবে? দিন পরে স্পেনের একটা আন্তজার্তিক বির্তক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল পরশের। এজন্য নতুন এনআইডি কার্ড, পাসপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু তার আগেই পরশ হত্যার শিকার হলো।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শেখ ফরহাদ বলেন,
নিখোঁজের ৭২ ঘন্টার পর নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশকে হত্যা করা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ এই তথ্য জানান।
ডা: শেখ ফরহাদ জানান, পরশের পুরো মাথা ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেগুলোর কোনোটাই সামান্য আঘাত নয়। তার ভিসেরা পাঠিয়েছি, অন্যান্য কিছু ২/৩ দিন পর আসলে বলতে পারবো সে কিভাবে মারা গেছে। প্রাথমিকভাবে বলবো, অবশ্যই এটা হত্যাকান্ড।
তিনি বলেন, ‘ফারদিনের পুরো মাথার বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়া গেছে। বুকের ভেতরে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝতে পেরেছি, এটি অবশ্যই হত্যাকাÐ। ময়নাতদন্ত শেষে দ্রæত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন জানান, তিনি বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ফারদিনের মা তার স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন একজন গৃহিণী। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফারদিন।
তাঁর মেজ ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশোনায় মেধাবী ফারদিন এসএসসি ও এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন। গবেষণায় আগ্রহ ছিল ফারদিনের। সে নিজের ইচ্ছায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মশিউর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানান, বুয়েট ছাত্র ফারদিনের লাশটি সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নদী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এখনো থানায় কেউ মামলা এজাহার দেয়নি। শুনেছি লাশের জানাযা দাফন নিয়ে ব্যস্ত আছে পরিবার। এজাহার পেলেই আমরা দ্রæত আইনী ব্যবস্থা নিয়ে মাঠে নামব। তবে দুজন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক হয়েছেন ঢাকায় । ময়না তদন্ত রিপোর্ট হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এ হত্যার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে।
ফতুল্লার দেলপাড়ার দাফন :
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পাগলা দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তৃতীয় জানাযা শেষে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের দাফন বাদ মাগরিব সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর আগে বিকেল সোয়া ৫টায় ফ্রিজিং গাড়িতে ফারদিন নূর পরশের লাশ দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে আনা হয়। এসময় তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা, চাচা আবু ইউসুফ, ছোট ভাই সালেহ নুর, তাদের বন্ধুরাসহ পরিবারের অনেকে সঙ্গে ছিলেন। নিহত পরশের নিজ বাড়ি পাগলা নয়ামাটি এলাকায়। তাঁর দাফনের সময় স্থানীয় মুসল্লিরা এবং স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন।