লঞ্চ-রেল-বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ভিড়

369

মিরর বাংলাদেশ : মহামারি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধে পরিবহন, দোকান-শপিংমল অফিস আদালতসহ ইমাজেন্সি সার্ভিস ছাড়া সব বন্ধ ছিলো। কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় বুধবার মধ্যরাত থেকে সারা দেশে চলছে গণপরিবহন। ঈদ ঘিরে গত দুইদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্টান্ড, রেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
অনেক জায়গায় টিকিটের জন্য ছিলো দীর্ঘ লাইন। সামাজিক দূরত্ব মানছেনা, স্বাস্থ্যবিধিও ছিল অনেকটাই উপেক্ষিত। তবে বৃহস্পতিবার চাইতে গতকাল শুক্রবার টার্মিনালগুলোতে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ঈদের আগে ঘরমুখি মানুষের ভিড় দিন দিন বাড়াবে।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে সরকারি কঠোর বিধিনিষেধ দুই সপ্তাহ পর শিথিল করেছে সরকার। কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের প্রথম দিনেই বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চালু হয়েছে। আর এ সুযোগে ঈদে নাড়ির টানে গ্রামের দিকে হুমড়ি খেয়ে ছুটছে মানুষ।
রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে ঘরমুখী মানুষের ঢল দেখা গেছে। এছাড়া সড়ক-মহাসড়ক, নৌ পথে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে দীর্ঘ যানজটের।
সকাল থেকে নগরীর ধানমন্ডি ২৭, নিউমার্কেট এলাকা, বাংলামোটর, শাহবাগ, দৈনিক বাংলা, ফকিরাপুল, আরামবাগ, কমলাপুর, কাকরাইল, পল্টন,, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, গাবতলিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় একই রকম চিত্র পাওয়া গেছে।
ফকিরাপুলে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্য ইসমাইল বলেন, বিধিনিষেধের গতকাল থেকেই মানুষ বের হচ্ছে। আজ গণপরিবহন চালু হওয়ায় যানজট আরো বেড়েছে। আর রিকশার সংখ্যা বেশি দেখছি। প্রতি সিগন্যালে ৫-১০ মিনিট করে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় এনামুল হকের সঙ্গে। তিনি যাত্রাবাড়ীতে কাজ করতেন, যাবেন সিলেটে। কাউন্টারে এসে দেখেন মানুষের অনেক ভিড়। অনেকেই সিলেট যাওয়ার জন্য টার্মিনালে এসেছেন।
এনামুল হক বলেন, আগে টিকেটের ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা। আর এখন ভাড়া চাচ্ছে ১২০০ টাকা। এক সিট বাদ দিয়ে নাকি নিয়ে যাবে। এজন্য দাম বেশি চাচ্ছে। তবে দাম যাই হোক না কেন বাড়িতে ফিরতেই হবে। ঈদ করে আবার ঢাকায় ফিরবেন তিনি।
সিলেটগামী পরিবহন গোল্ডেন লাইনের সুপার ভাইজার আল মামুন বলেন, এক সিট পর এক সিটে যাত্রী বসানো হচ্ছে। টিকেটও সেভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। কাউকে মাস্ক ছাড়া গাড়িতে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। অসুস্থ যাত্রীদের নেওয়া হচ্ছে না।
গাবতলী বাস টার্মিনালে কথা হয় ইদ্রীস মিয়ার সঙ্গে। তিনি যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। টিকেট কেটে বসে আছেন। গাড়ি ঢুকতে পারেনি তাই কাউন্টারেই বসে আছেন তিনি।
নাবিলের কাউন্টারে বসে আছেন রবিউল আলম, যাবেন দিনাজপুর। যানজটের কারণে গাড়ি আটকে আছে আশুলিয়ায়। সেজন্য দেরি হচ্ছে। টিকেটের দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৮০০ টাকা ছিল টিকেটের দাম। দাম নিয়েছে ১২০০ টাকা। স্বাস্থ্য বিধি মেনে তারা গাড়িতে যাত্রী উঠাবেন বলে জানানো হয়েছে।
নাবিল কাউন্টারের সহকারী ম্যানেজার বোরহান উদ্দিন বলেন, শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালানো হচ্ছে। গাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে। মাস্ক ছাড়া কাউকে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না।
মহাখালী বাস টার্মিনালে ময়মনসিংহগামী বাসের যাত্রী আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, করোনায় মনে হয়েছিল এবার বাড়িতে যাওয়া হবে না। সরকার গাড়ি খুলে দিয়েছে তাই বাড়িতে গিয়েই ঈদ করতে চাই। টিকেটের মুল্য নিয়েছে ৫০০ টাকা। আগে ছিল ২০০ টাকা। এনা পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব যাত্রী যাতায়াত করছে বলে জানান এনার কাউন্টার ম্যানেজার রাকিব হাসান।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচালকারী পরিবহনগুলোতেও যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, যাত্রীদের বেশিরভাগই গ্রামমুখী। ব্যাগ-বস্তা নিয়ে তারা একস্থান থেকে আরেকস্থানে ছুটছেন। যাত্রীদের বেশিরভাগই বাস টার্মিনালমুখী।
গণপরিবহনগুলো চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকা যেন তার চিরচেনা রুপে ফিরেছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ির চাপও বেড়েছে অনেক, এছাড়া মাইক্রোবাস, জরুরি সেবা সংস্থার গাড়ি এবং খোলা থাকা অফিস কর্মীদের বহনের গাড়িতে পুরনো রূপে ফিরেছে রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলো। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্টও দেখা গেছে। তবে অকারণে বাইরে বের হলেও মামলা না থাকায় স্বস্তিতে সাধারণ মানুষ।
বনি আমিন একজন চাকরিজীবী। ঈদের ছুটির আগেই ব্যাগ নিয়ে ছুটেছেন ঝিনাইদহ জেলার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, ‘গণপরিবহন চালু হলেও বাসের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যেভাবেই হোক ঢাকা থেকে যেতে হবে ফেরিঘাটে। সেখানেও নাকি মানুষের উপচেপড়া ভীড়। কিন্তু কি করার আছে, বাড়িতো যেতেই হবে।’
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে পরিবহন চালানোর কথা থাকলে তার তোয়াক্কা করছেন না অনেকেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহনগুলো চালাচলের কথা বলা হলেও তা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে গাবতলী এলাকায় কর্মরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, এতো মানুষের চাপ সামলানো আমাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সড়কে ঘরমুখো মানুষের প্রচÐ ভীড়। সামাজিক দুরত্বও অনেকে মেনে চললেও কেউ কেউ মানছে না।
কঠোর বিধিনিষেধের পর শুরু হয়েছে লঞ্চ চলাচল। তবে লঞ্চ চলাচলের দ্বিতীয় দিন ঘাটে ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। এ সময় লঞ্চ ভিড়লেই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে লঞ্চে উঠতে দেখা গেছে যাত্রীদের।
বি আইডবিøউটিএ বলছে, ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ঘাট ছেড়েছে সব লঞ্চ। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের আগেও অনেক লঞ্চকে ঘাট থেকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে বি আইডবিøউটিএ।
এমভি প্রিন্স অব রাসেল লঞ্চের যাত্রী সুলতানা খানম বলেন, ‘বিধিনিষেধের জন্য ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে যেতে পারিনি। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ গত ঈদে আমরা দেখেছি যাত্রীদের কত কষ্ট করে ঈদ উদযাপনের জন্য বাড়িতে যেতে হয়েছে।’
জাকির হোসেন নামের আরেক যাত্রী জানান, ‘সচেতনতা আমাদের মধ্যে অনেক কম কাজ করছে। সরকার আমাদের কথা চিন্তা করে কিছু নিয়ম মেনে লঞ্চে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো সেগুলো কিছুই মানছি না, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’
লঞ্চের সুপারভাইজার আজগর আলী বলেন, ‘ঘাটে লঞ্চ ভিড়লেই যাত্রীরা লঞ্চে উঠতে হুড়োহুড়ি করে। তারা মনে করেন, লঞ্চে জায়গা পাবেন না। তাদের ফলে স্বাস্থ্যবিধি নষ্ট হচ্ছে। আমরা যাত্রীদের মাস্ক নিশ্চিত ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে লঞ্চে প্রবেশ করাচ্ছি। স্বাস্থ্যবিধি যাতে উপেক্ষিত না হয়, আমরা সর্বদা মনিটরিং করছি।’
এর আগে এদিকে ঈদকে সামনে রেখে করোনার উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও চলমান কঠোর বিধিনিষেধ ২৩ জুলাই পর্যন্ত শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তবে ঈদের পর আবারও ১৪ দিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এতে বলা হয়েছে- ১৪ জুলাই মধ্য রাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত চলমান বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো। একইসঙ্গে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনষেধ আরোপ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পবিত্র ঈদুল আযহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আরোপিত সকল বিধি-নিষেধ শিথিল করা হলো। তবে এ সময়ে সর্বাবস্থায় জনসাধারণকে সতর্কাবস্থায় থাকা এবং মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে