মিরর বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস এবং বর্বরতার ঘটনা দেশবাসী যেন ভুলে না যায়। সেই দিন যেন ফিরে না আসে। সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
রোববার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নি সন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খন্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা এবং কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার শুধু একটাই আহ্বান থাকবে দেশবাসীর কাছে, রাজনীতি করতে চাইলে সুষ্ঠু রাজনীতি করুক, আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমার এই সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নাই। আমি শুধু দেশবাসীকে এটুকুই বলবো, ওই দুঃসময়ের কথা যেন কেউ ভুলে না যায়।
তিনি বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেধাবী ছাত্রদের হাতে অর্থ, অস্ত্র, মাদক তুলে দিয়ে বিপথে ঠেলে দিয়েছে। ‘৭৫-এর পর এই ছিল বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কেবল স্থিতিশীলতা এসেছিল।
সে সময় শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা, উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি করতে পেরেছিলেন এবং যতটুকু সম্ভব তার সরকার মানব কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরমধ্যে আগুন সন্ত্রাসের মতো ঘটনা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।
আগুন সন্ত্রাসীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এদের বিচার হচ্ছে, হবে এবং মহান আল্লাহর তরফ থেকেই হবে। হয়তো প্রত্যেক কেসেই (মামলা) বিচার চলছে না। কিন্তু যারা এ ধরনের অগ্নিসন্ত্রাসে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, অনেকের বিচারের কাজ চলছে অনেকে শাস্তিও পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা হুকুমদাত্রী বা হুকুমদাতা, তাদের কথাও আপনারা ভেবে দেখেন। যারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে আর মানুষকে কষ্ট দিতে পারে, আমি জানি না মানুষ কীভাবে আবার এদের পাশে দাঁড়ায়, এদের সমর্থন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের ঘটনা যেন কেউ ভবিষ্যতে আর ঘটাতে না পারে। কেননা, দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনভাবে নিজ নিজ জীবন-জীবিকার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকের সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার সংরক্ষণ করাটাই আমাদের দায়িত্ব। আর সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
অনুষ্ঠানে ‘আগুন সন্ত্রাসের দুর্ভোগ: বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আংশিক দৃশ্যপট’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নি-সন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খÐচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে অগ্নি-সন্ত্রাসের স্মৃতিচারণ করেছেন ওই নির্মম ঘটনার শিকার আহত ও নিহতের স্বজনরা। এ সময় সন্তানের লাশ দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের কথা বলেন সন্তানহারা মা। চোখের সামনে পুড়ে ছারখার হতে দেখা সন্তানকে বাঁচাতে না পারার কষ্টের কথা জানান অসহায় পিতা। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে স্বামীকে কেন পিটিয়ে হত্যা করা হলোÍ সেই প্রশ্ন তোলেন স্বামীহারা স্ত্রী। তাদের আবেগঘন বক্তব্যে ভারী হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানস্থল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
আহত ও নিহতের পরিবার ওই নির্মম ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান। নিজেদের জীবদ্দশায় ওই বিচার দেখে যেতে চান। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে বর্তমানে মানবতর জীবনযাপনকারী এসব পরিবারের সদস্যরা আর্থিক অনুদান ও জীবিকার ব্যবস্থাও চেয়েছেন।
২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের টানা আন্দোলনের সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসন্ত্রাস, ভাঙচুর ও হত্যাকাÐের শিকার নিহতের ঘটনার আংশিক চিত্র তুলে ধরতে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এতে ঢাকাস্থ বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে বাসে অগ্নিকাÐে নিহত নাহিদের মা রুনি বেগম বলেন, ‘শাহবাগে আমার সন্তানরে পেট্রল বোম দিয়ে পুড়ায় মারছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলাম। আমরা আমার সন্তানকে দেখতেও পারি নাই।’
এ সময় কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানরে দেখার সুযোগ দেয় নাই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামরা। তার কারণে আজও আমি অসুস্থ। সেই ঘটনায় আমি বিচার পাই নাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি আমার মা, আমি আপনার সন্তান। আপনি বিচার করবেন।’ রুনি বেগম জানান, তিনি কোনও সহযোগিতা পাননি।
গাজীপুরে কার্ভাড ভ্যানে অগ্নিকাÐে নিহত বালক মনির হোসেন। তার বাবা রমজান আলী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি তো কোনও রাজনীতি করি না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে, ছোট ছেলেটাকে তারা আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো, কিন্তু আমি বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে কোথাও নাই।’ তিনি সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।
কাঁচপুরে নিহত বিজিবির সুবেদার নায়েক শাহে আলমের স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, ‘আমার স্বামীতো রাজনীতি করেনি। সেতো দেশের কাজে নিয়োজিত ছিল। তাকে কেন এইভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামীকে যারা এভাবে হত্যা করেছে, তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর বিচার চাই।’ নিজে ও সন্তানেরা বেঁচে থাকতে এ বিচার দেখে যেতে চান তিনি।
অগ্নিকাÐে নিহত পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়ার স্ত্রী মায়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী গোপালগঞ্জে চাকরি করতো। সেখান থেকে কাঁচপুর এলে হেফাজত বাহিনীরা আমার স্বামীরে হত্যা করছে। এর বিচার আমি চাই।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে দুইটা। তাগো কিছু ব্যবস্থা কইরবেন। আমার শইল সুস্থ না, সেটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।’
হামলার ঘটনা বর্ণনা করে চট্টগ্রামের চিত্র সাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না বলেন, ‘রাজনীতিটা প্রতিযোগিতামূলক ও সুন্দর হবে। সেটাই আমরা চাই। রাজনীতির নামে মানুষকে মারবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা বিচার চাই।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত আবারও শুরু করেছে। আবার সেই একই কাহিনী। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি। তারা আবারও পুরনো পরিকল্পনা করেছে। আমরা সবাই প্রতিহত করবো।’
২০১৩ সালের মার্চে রাজশাহীর সাহেব বাজারে বোমা হামলায় আহত পুলিশের এসআই মকবুল হোসেন বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের নিক্ষিপ্ত বোমায় আমার দুটি হাত হারিয়ে ফেলি। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গু হয়েছি। কিন্তু মনোবল হারাইনি। কিন্তু এখনও জামায়াত-শিবিরের কথিত সাংবাদিক প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নামে-বেনামে আমার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দরখাস্ত দিয়ে আমার পদোন্নতি আটকে দিয়েছে। জামায়াতের বিভিন্ন সাংবাদিক পুলিশের মনোবল নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু আমরা মানুষের জানমাল রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত।’
২০১৩ বাসে আগুন দেওয়া হলে তাতে আহত হন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের দোকান কর্মচারী সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আগে কর্ম করে খেতাম। কিন্তু আগুনে পুড়ে এখন আমার চেহারা বিকৃত হওয়ার পরে কেউ চাকরি দিতে চান না। আমার কাজ করার শক্তি আছে, কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। আমার দুইটা ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের একটা কিছুর ব্যবস্থা করুন। আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। আমাকে একটু কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এসব ঘটনা শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ কয়েকবার চোখের জল মুছতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে থাকা অনেককেই চোখের জল মুছতে দেখা গেছে।
Home প্রধান সংবাদ বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস ও বর্বরতার ঘটনা দেশবাসী যেন ভুলে না যায় : প্রধানমন্ত্রী