শেষ হচ্ছে না লোড শেডিংয়ের যন্ত্রণা

278

* গরমের আঁচ লেগেছে বিদ্যুতে
*  কয়লা সংকটে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ * শহরের চয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ

মিরর বাংলাদেশ  : টানা তাপদাহে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা ও যোগানের পার্থক্যও বাড়ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন ও আমদানি বাড়িয়েও লোড শেডিংয়ের যন্ত্রণা শেষ হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকদের বরাবরের মতই ভুগতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার থেকে কেন্দ্রে হামলা, মিছিল বের করার খবর এসেছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে দিনে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। লোড শেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়ছেন বেশির ভাগ এলাকার মানুষ। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের ভোগান্তি।
সূত্র জানায় তীব্র তাপপ্রবাহ সেই দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। তপ্ত আবহাওয়ায় পুড়তে থাকার এসময়ে একের পর এক দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডও হচ্ছে। গত মঙ্গলবার দেশজুড়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও তীব্র গরমে পুড়ছে জনজীবন। এরই মধ্যে বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়া শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছে। তবে লোড শেডিংয়ের এ যন্ত্রণা নগরের চেয়ে বেশি গ্রামে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপদাহ বাড়ার সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ফলে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও চাহিদা মিটছে না; লোড শেডিং করতে হচ্ছে।
এর মধ্যেই কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেকগুলো ছোট-বড় কেন্দ্র গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুতের যোগান ও চাহিদাতে সেটিও প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান।
দেশে বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদার চেয়েও উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ার পরও তা কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে উৎপাদন সক্ষমতার শতভাগ একই সঙ্গে কাজে লাগানো যায় না। রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে চাহিদার চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা রাখতে হয়। কারণ, একসঙ্গে সক্ষমতার সবটুকু সচল থাকবে এটা বাস্তব সম্মত নয়।
দেশে স্থাপিত ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫০ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গত কয়েকদিন ধরে চাহিদা বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনেও রেকর্ড হচ্ছে। তবে এরপরও চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বড় ব্যবধান থাকায় লোড শেডিং করতে হচ্ছে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক বছর আগের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিলে বিকালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট, যা তখন উৎপাদন করে পূরণ করা গেছে। এক বছরের মাথায় সেই চাহিদা বেড়ে ১৬,০০০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল রোববার আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে ১৪ হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন করা গেছে। সেদিন দেশজুড়ে ১২০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল বলে পিডিবি দাবি করছে।
তবে সারাদেশে যে পরিমাণ লোড শেডিং হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সমিতিগুলোর অধীনে।পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির অধীনে প্রায় তিন কোটি গ্রাহকের জন্য গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গড়ে দৈনিক প্রায় নয় হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। এর বিপরীতে যোগান দেওয়া যাচ্ছে সাত হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একজন কর্মকর্তা জানান, দিনের বেলায় বেলা ১২টার দিকে চাহিদা ও যোগানের ব্যবধানের আরও বাড়ে। কারণ সেই সময় বিদ্যুতের উৎপাদন কম থাকে। দিনের বেলা আট হাজার মেগাওয়াট ও রাতে নয় হাজার মেগাওয়াট চাহিদা থাকে। কিন্তু দিনে উৎপাদন কম থাকায় লোড শেডিং করতে হয় বেশি। গত এক সপ্তাহ ধরে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের ব্যবধান থাকছে বলে তিনি জানান।
এদিকে তীব্র গরমের মধ্যে টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার যন্ত্রণায় নগরের চেয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ।
লোড শেডিংয়ের দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে সোমবার রাতে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের একটি শাখা অফিসে হামলা চালিয়েছে স্থানীয়রা। সেখানে দৈনিক ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোড শেডিং হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। এলাকাবাসী হামলা করেছে ফুলগাজী উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে। সেখানে ইট- পাটকেল নিক্ষেপ করেছে ‘বিক্ষুব্ধ’ গ্রাহকরা। এই দুই ঘটনার পর ছাগলনাইয়ায় হামলার ঘটনার পর থেকে সোনাগাজীর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসগুলো পাহারা দিচ্ছে ছাত্রলীগ। অপরদিকে হবিগঞ্জ সদরে টানা লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শহরবাসী। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে সোমবার দুপুরে শহরের আরডি হল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার শহরতলীর বাসিন্দা জান্নাত চামেলী জানান, দিনে ও রাতের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে তার বৃদ্ধ মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করলেও এসময়ে একটু স্বস্তির জন্য নিচ তলায় এসে অবস্থান নিয়েছেন। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় অস্বস্তি আরও বেড়েছে। গত দুই দিন ধরে ভোর রাতে সেহরির সময়ও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই অভিযোগ করেন নোয়াখালী সদরের বাসিন্দা গৃহিণী সাহিদা আক্তার ও বগুড়া সদরের বাসিন্দা সাদিক রেজা। বগুড়ায় গত দুই তিন ধরে এবং নোয়াখালীতে গত এক সপ্তাহ ধরে দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না বলে তাদের অভিযোগ।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে স্থাপিত ১৫০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ও ভারত থেকে আমদানি মিলিয়ে দৈনিক ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এর বাইরে ভারতের ঝাড়খÐে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর পৌর এলাকায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা করে লোড শেডিং হচ্ছে। কোনো কোনো সময় এর চেয়ে বেশিও লোডশেডিং হচ্ছে। এদিকে শহরের বাহিরের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গ্রামাঞ্চলে দিন রাত মিলিয়ে ১১ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে চিকিৎসা, শিল্পকারখানা ও কৃষিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। এতে তীব্র গরমে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বাসিন্দারা।
এদিকে কয়লা সঙ্কটে আবারো বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের রামপাল বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত ৭ দিন ধরে বন্ধ থাকা এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির পর আগামী সপ্তাহে ফের চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ এপ্রিল রাত থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিনদিন বন্ধ ছিল রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।