বজ্রপাত ঠেকাতে সরকারের ১৩’শ কোটি টাকার প্রকল্প

224

* তালগাছ প্রকল্প বাতিল,থাকছে ‘লাইটিনিং অ্যারেস্টার ও লাইটিনিং ‘শেল্টার’ নির্মাণ

মিরর বাংলাদেশ : দেশে বজ্রপাত এক ধরনের আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টি আর ঝড় হলেই বজ্রপাতে একাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কালবৈশাখীর এই মৌসুমে এ আতঙ্ক আরও বেড়েছে। এমনকি গত শনিবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত ২৭ এপ্রিল ৬টি জেলায় ৮ জনের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। তার আগে ২৩ এপ্রিল মারা যান ৯ জন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বছরে বজ্রপাতে গড়ে ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়।
যদিও বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সারাদেশে এক কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। এর মধ্যে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর দেখা যায় তা এক বছরের মধ্যেই অযতেœ অবহেলায় মারা যায়। বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ রোপনের মতো কর্মসূচি সরকার হাতে নিলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। প্রকল্পের নামে অপচয় হয়েছে অর্থের। পরে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন ১৩০০ কোটি ব্যয়ে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তালগাছ প্রকল্প বাতিল করে এখন ‘লাইটিনিং অ্যারেস্টার ও লাইটিনিং শেল্টার’ নির্মাণ এবং ‘আর্লি ওয়ার্নিং ফর লাইটিনিং, সাইক্লোন অ্যান্ড ফ্লাড’ নামের দুইটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।’
ফিনল্যান্ড ভিত্তিক বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের ৭০ ভাগই কৃষক বা যারা খোলা মাঠে কাজ করেন। এছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের বজ্রপাতের ফলে মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে যাওয়ার এবং খোলা মাঠ বেশি থাকায় সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
তারা বলছেন, দেশের হাওড় এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি পায় সেখানে গিয়ে পড়ে। বৃক্ষহীন হাওর এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই সেখানে যারা থাকেন তারা শিকার হন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে কমবেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। গত এক যুগে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন এবং ২০১৫ সালে ১৬০ মারা গেছেন। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেলের প্রধান আবদুল আলীম জানান, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ দুইটি।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গাছ বিশেষ করে মাঠের উঁচু গাছ কেটে ফেলা। হাওর অঞ্চলের মাঠে আগেও তেমন গাছ ছিল না। এখন অন্যান্য এলাকার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে মাঠে বা খোলা জায়গায় যে সব মানুষ থাকেন বজ্রপাতের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহী উঁচু জিনিস হিসেবে সেই মানুষকেই পায়। মানুষ না থাকলে মাঠের গবাদি পশু। ফলে মানুষ মারা যায়, গবাদি পশুও মারা যায়।
তার পরামর্শ হলো, আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে বা ঝড় বৃষ্টি শুরুর সংকেত পাওয়া গেলে মানুষকে এমন কোনো স্থাপনায় আশ্রয় নিতে হবে যা বিদ্যুৎ পরিবাহী। কোনোভাবেই গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কারণ গাছ বিদ্যুৎ পরিবাহী। গাছের নিচে আশ্রয় নিলে গাছের বিদ্যুৎ মানুষকে আক্রান্ত করবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, তালগাছ প্রকল্প আমরা বাতিল করেছি। এটা কোনো ফল দেয়নি। আর তালগাছ বড় হতে অনেক বছর সময় লাগে। এখন আমরা লাইটিনিং অ্যারেস্টারসহ লাইটিনিং শেল্টার নির্মাণ এবং আর্লি ওয়ার্নিং ফর লাইটিনিং, সাইক্লোন অ্যান্ড ফ্লড-এই দুইটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এই প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে বজ্রপাত প্রবণ ১৫টি জেলায় লাইটিনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করেছি। গত বছর টিআর-কাবিখার প্রজেক্টের অর্থ দিয়ে আমরা এগুলো স্থাপন করেছি। পর্যায়ক্রমে বজ্রপাত প্রবণ জেলায় এগুলো বসানো হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলছেন, দেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে ২৫০-৩০০ লোক মারা যায়। এর মূল কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাত বেড়ে গেছে। এক ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়লে ১২ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়।