* দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুক্তভোগীদের বিক্ষোভ মানববন্ধন
মিরর বাংলাদেশ : এক দিকে ভয়াবহ লোড শেডিং অন্যদিকে ভুতুড়ে বিল দ্ইুয়ে মিলে দিশেহারা বিদ্যুতের লাখ লাখ গ্রাহক। বিদ্যুত না পেয়ে মাস শেষ গুনতে হচ্ছে বিল। তার মধ্যে প্রতিমাসেই আসছে বাড়তি বিল । ভুক্তভোগীরা বিদ্যুত অফিসগুলোতে বারবার অভিযোগ দেয়ার পরও কোন কাজ হচ্ছে। অবশেষে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে গ্রাহকরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করার খবরও পাওয়া গেছে ভুতুড়ে বিলের বিরুদ্ধে।
মাত্রারিক্ত বিদ্যুৎ বিল, ভায়াবহ লোডশেডিংসহ নানা অভিযোগে চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের সামনে বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা মানববন্ধন করেছে। গতকাল রোববার দুপুরে ফরিদগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে উপজেলার চরদুঃখিয়া পূর্ব ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের লোকজন এই কর্মসূচী পালন করে। তাদের সাথে মানববন্ধনে যোগ দেন ফরিদগঞ্জ সদরের কিছু লোকজন। এসময় সড়কে কিছুক্ষণ যানজটের সৃষ্টি হয়।
থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পর চাঁদপুর পল্লীবদ্যুৎ সমিতি-২ ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের ডিজিএম প্রকৌশলী কামাল হোসেন এসে গ্রাহকদের সমস্যা শুনে সমাধানের আশ্বাস দিলে গ্রাহকরা মানববন্ধন ত্যাগ করেন।
পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের আওতাধীন ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১ লাখ ৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের মতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে তাদের।
চরদুঃখিয়া পুর্ব ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের বিদ্যুৎ গ্রাহক ইলিয়াস কাঞ্চন, মো. রাশেদ আলম, রাব্বি, সাব্বির, রাব্বি সওদাগর, মোবারক হোসেন, আব্দুল হান্নান, আনোয়ার হোসেন, মনির হোসেনসহ লোকজন জানায়, দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র কয়েক ঘন্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। ভয়াবহ লোডশেডিং হলেও গত কয়েকমাস ধরে বিদ্যুৎ বিলের পরিমানও মাত্রারিক্ত বেড়েছে। মিটার রিডাররা মিটারের কাছে না গিয়ে মনগড়া বিল তৈরি করছেন। এতে গ্রাহকরা বিপুল অংকের অর্থ গচ্ছা দিচ্ছেন। লোডশেডিং হ্রাস, প্রকৃত বিদ্যুৎ বিল প্রদান এবং লাইন সংস্কারে অনিয়মসহ নানা অভিযোগের সুরাহার দাবীতে তারা বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে মানববন্ধন করতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় মানুষ জনের জড়ো হওয়ার সংবাদ পেয়ে থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে লোকজনকে শান্ত করেন। এসময় সড়কের পাশে তাদের সরিয়ে নিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করেন।
চাঁদপুর পল্লীবদ্যুৎ সমিতি-২ ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের ডিজিএম প্রকৌশলী কামাল হোসেন জানান, তার অফিসের সামনে গ্রাহকদের জড়ো হওয়ার সংবাদে তিনি তাদের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
ভুতুরে বিল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১- এর গ্রাহকরা। দুই মাস ধরে বিদ্যুৎ বিলের কাগজে হিসাব মিলছে না অধিকাংশ গ্রাহকের। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি বিলে অতিরিক্ত টাকা যোগ করে দেয়া হয়েছে। বার বার বললেও মিলছে না প্রতিকার, বরং বাড়ছেই বিল।
জানা যায়, যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর গ্রাহক। গত দুই মাস ধরে এ এলাকার প্রতিটি বিলের সঙ্গেই যোগ করা হয়েছে অতিরিক্ত টাকা।
গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রত্যেকটি বিলেই অতিরিক্ত ৮০ থেকে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বেশি যোগ করা হয়েছে। বিল নিয়ে অফিসে ঘোরার পরও কোনো সমাধান দিতে পারছেন না সমিতির লোকজন। পরবর্তী মাসে সমন্বয় করে দেয়ার আশ্বাস দিলেও তা শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ। পরের বার গেলে বরং অফিসের লোকজন দুর্ব্যবহার করেন। তাদের দাবি, বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন গ্রাহকের বাড়িতে না এসে অফিসে বসেই বিল তৈরি করছেন, যে কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কেবল নরেন্দ্রপুর নয়, এমন চিত্র সমিতির আওতায় থাকা অন্য এলাকাতেও বিদ্যমান বলে জানা গেছে। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগের মনগড়া বিলের কারণে ক্ষোভ ভুক্তভোগীদের মধ্যে।
সাইফুল ইসলাম নামে এক গ্রাহক বলেন, ‘আমরা সাধারণ আবাসিক গ্রাহক। আমাদের যাদের গত মাসে ৮০০ টাকা বিল এসেছে, এ মাসে ৪ হাজার টাকা বিল দিয়েছে। মিটার রিডিং পরীক্ষা করে দেখা যায়, ১৫০ থেকে ২০০ ইউনিট বেশি ধরে বিল করা হয়েছে। আমরা অফিসে অভিযোগ নিয়ে গেলে বলে সমন্বয় করে দেয়া হবে। কিন্তু তা করা হয় না, বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিলের কারণে আমরা অতিষ্ঠ হয় পড়েছি।’
তৌহিদুর রহমান নামে আরেক এক গ্রাহক বলেন, ‘এখন দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তার ওপর বিদ্যুৎ অফিসের ভূতুড়ে বিলের অত্যাচারে নাভিশ্বাস অবস্থা। আমার ঘরে দুটি লাইট জ্বলে। ২০০ টাকা বিল আসতো। কিন্তু গত দুই মাস ধরে ৮০০ টাকা বিল আসছে। আমি রিকশা চালিয়ে যে আয় করি তা দিয়ে সমন্বয় করতে পারছি না।’
আব্দুস সাত্তার নামে আরেক গ্রাহক বলেন, ‘আমার দুটি লাইট, একটা ফ্যান ও ফ্রিজ চলে। গত মাসে বাড়তি বিল করা হয়। আমি অভিযোগ করলে বলে, এ মাসে টাকা দিয়ে দেন। আগামী মাসে সমন্বয় করে দেব। কিন্তু চলতি মাসে বিল আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এ টাকা কিভাবে দেব। অফিসে গিয়ে হিসাব চাইলে বলে যা লেখা হয়ে গেছে ওটা ঠিক হবে না। বিদ্যুৎ অফিস যা খুশি তাই করছে। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই।’
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার মো. ইছাহাক আলী দাবি করেন, তাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ নিয়ে গ্রাহকরা আসলে সমস্যার সমাধান করে দেয়া হবে।
মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ভুতুড়ে বিলে দিশাহারা লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকরা। গত দুই মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এ ছাড়াও সার্ভিস ড্রপের সরবরাহ বন্ধ এবং নতুন মিটার না থাকায় দেওয়া হচ্ছে না নতুন সংযোগও। অভিযোগ জানাতে গেলে গ্রাহকদের বলা হয় মিটার রিডিং ভিডিও করে আনার জন্য। সব মিলিয়ে নানা অভিযোগ রামগতি ও কমলনগর উপজেলা পল্লী বিদ্যুতের প্রতি। সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না তারা।
নষ্ট মিটার পরিবর্তনের আবেদন দীর্ঘদিন পড়ে থাকলেও পরিবর্তন হচ্ছে না মিটার। আবার গ্রাহককে না জানিয়েও পরিবর্তন করে লাগানো হচ্ছে পুরাতন মিটার বলে অভিযোগ। উপজেলার নুরিয়া হাজিরহাট এলাকার চা-দোকানি মো. বয়ান। দোকানে দুটি ফ্যান ও দুটি লাইট ব্যবহার করছেন। গত মে মাসে তার বিল আসে ২ হাজার ৭৯ টাকা। অভিযোগ জানাতে গেলে অফিস থেকে বলা হয়, মিটার নষ্ট তাই বিল বেশি আসতে পারে। মিটার পরিবর্তন করতে হবে। আগে কাগজে আসা বিল পুরোপুরি জমা দিতে হবে, তারপর অভিযোগ ও মিটার পরিবর্তনের আবেদন করতে হবে। অতিরিক্ত বিল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফিরে আসেন তিনি।
মো. বয়ান বলেন, মাসে দুই-আড়াইশ টাকার বেশি বিল আসে আসে না। হুট করে মে মাসে বেশি বিল আসে। অফিসে গেলে বলা হয়, মিটার পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি সমাধান করতে সময় লাগবে। না জানিয়ে মিটার কেন পরিবর্তন করা হয়েছেÑ এমন প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর পাইনি।
চররমিজ ইউনিয়নের চরমেহার গ্রামের বেলাল উদ্দিন জানান, বছরের শুরু থেকে অস্বাভাবিক বিলের অভিযোগ নিয়ে গেছেন অফিসে। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত বিল বাবদ ৩ হাজার টাকা জমা দিয়ে অভিযোগ করেন। মিটার পরিবর্তনের জন্য ২৭০ টাকা দিয়ে আবেদন করার তিন মাস পার হলেও পরিবর্তন হয়নি।
রামগতি পৌরসভার চর হাসান-হোসেন গ্রামের বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিনের এপ্রিলে ব্যবহৃত ইউনিট ছিল ১ হাজার ৮৯৫, মে মাসেও ব্যবহৃত ইউনিটও ১ হাজার ৮৯৫। কিন্তু মে মাসে বিল করা হয়েছে ৩৯৫ ইউনিটের। কামাল উদ্দিনের অভিযোগ বিগত দিনগুলোতে গড়ে ৪০ থেকে ৬০ ইউনিটের মধ্যে বিল এলেও মে মাসে অস্বাভাবিক বিল আসছে। অভিযোগ জানাতে গেলে আগে বিল পরিশোধ করে তারপর মিটার পরিবর্তনের আবেদন করতে বলা হয়। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এখনও মিটার পরিবর্তন হয়নি।
রামগতি পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক শাহাদাত হোসেন, আশরাফ উদ্দিন আসিফ, শরীফ উদ্দিনসহ কয়েকজন জানান, লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় জীবনযাপন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একদিকে তীব্র গরমে ঘুমাতে পারছি না। অন্যদিকে অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি বিল আসছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাবিনা ইয়াছমিন ও মো. মেজবাহ জানান, দৈনিক ৪ থেকে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। ৩০ জুন থেকে পরীক্ষা শুরু। পড়ালেখা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরীক্ষা দেওয়াটাও কঠিন হবে।
রামগতি পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৬৫ হাজার। গ্রাহকদের বহুবিধ সুবিধার কথা মাথায় রেখে সাধারণ মিটারগুলোকে প্রিপেইড মিটারে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৩৮ হাজার গ্রাহকের জন্য প্রিপেইড মিটারের একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এ কাজ শুরু হবে। উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৪ মেগাওয়াট। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে ৪ থেকে ৫ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পেলে লোডশেডিং কমবে।
সমিতির ডিজিএম রেজাউল করিম বলেন, রামগতি এলাকার পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকরা সচেতন নয়। তারা বিলের সঙ্গে মিটার রিডিং মেলান না। এ ছাড়াও আমাদের মিটার রিডাররাও না দেখেই গড়পড়তা ইউনিট লিখে দেয়। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করায় ইতোমধ্যে ১২ জন মিটার রিডারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কেউ অভিযোগ করলে সমাধান করে দেওয়া হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা ডিজিএম নিতীশ সাহা বলেন, উপজেলায় প্রায় ৫৬ হাজার গ্রাহক রয়েছে। বিদ্যুৎ চাহিদা ১০ মেগাওয়াট। কিন্তু আমরা পাচ্ছি মাত্র সাড় ৪ মেগাওয়াট। এত অল্প মেগাওয়াট দিয়ে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।
কারিগরি ও অকারিগরি কারণে অনেক সময় ভুতুড়ে বিলের ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, ‘৬টি বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা/কোম্পানির মোট গ্রাহক ৪ কোটি ৭১ লাখ। বিদ্যুৎ বিল যাতে যথাযথ হয়, সে বিষয়ে বহুবিদ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কারিগরি ও অকারিগরি কারণে অনেক সময় ভুতুড়ে বিলের ঘটনা ঘটতে পারে। ভুতুড়ে/অস্বাভাবিক বিল রোধকল্পে অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রি-পেইড/স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’