আর্থিক অনিশ্চয়তায় শহর ছেড়ে গ্রামমূখি মানুষ

626

মিরর বাংলাদেশ : করোনা কালে আর্থিক অনিশ্চয়তায় শহরে ছাড়ছে মানুষ। রাজধানী ও আশ্বেপাশ্বের জেলা নারায়ণগঞ্জ,গাজিপুর, সাভারসহ অন্যন্য এলাকা থেকে ভাড়া বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে অনেকে। আয় না থাকায় অনেকে বাসা ভাড়া দিতে পারছে না তা ছাড়া করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা না জানার কারনে শহর ছাড়ছে তারা। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ায় অনেকে বাসাবাড়ি ফ্লাটে ঝুলছে টুলেট সাইনবোর্ড। অনেক বাড়ি ওয়ালা পড়েছেন বিপাকে বিশেষ করে ভাড়া দিয়ে যাদের খরচ চলে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রাজধানীর বাড়িওয়ালারা বিপাকে পড়েছেন। এমন অনেক বাড়িওয়ালা পাওয়া গেছে যাদের বাসায় দুটি ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, এর আশপাশে সাভার এলাকা থেকে শুরু করে, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জের মতো এলাকাতেও এর প্রভাব পড়েছে।
করোনার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কারও ব্যবসা চলছে না। কেউবা আবার ভয়ে ঢাকা ছাড়ছেন। করোনার সময়ে বাড়ি ভাড়া মওকুফ কিংবা কমানোর দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হচ্ছেন অনেকে। অনেকে আবার পরিবার-পরিজন গ্রামে রেখে নিজে মেসে উঠেছেন।
রাজধানী ও এর আশেপাশের বেশ কয়েকজন বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বাসা খুব বেশি একটা খালি থাকে না, কিন্তু এখন থাকছে। আবার অনেকে বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে ছোট ফ্ল্যাটে উঠছেন।
উত্তর বাড্ডার আলীর মোড়ের পূর্বাঞ্চল সড়কের দুটি বাড়ির মালিক নোয়াখালীর মফিজ মিয়া। প্রায় ১০ বছর আগে বাড়ি দুটি করেন। প্রতি বাড়িতে ২৪টি করে ফ্ল্যাট। দুই রুমের ফ্ল্যাটগুলোর চাহিদা সবসময়ই বেশি। কোনো সময় ফাঁকা থাকত না। কিন্তু চলতি মাসে তার দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া হয়নি। এর আগে এমনটি কখনও হয়নি বলে জানান তিনি।
মফিজ মিয়া বলেন, ‘আমার বাসায় টু লেট লাগানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই ভাড়া হয়ে যেত। কারণ ঢাকায় এমন ছোট ফ্ল্যাট পাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু এই মাসে (জুলাই) দুটি ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর সৌদিতে থেকে জমি কেনার পর ব্যাংক লোন নিয়ে বাড়ি দুটি করেছি। এজন্য দুশ্চিন্তায় আছি।’
রাজধানীর কাঁঠালবাগানের ঢালে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন গোলাম রব্বানী। তিনি দেশীয় একটি কোম্পানির ডেলিভারি ম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু মার্চ থেকে তার কাজ বন্ধ। তিন মাসের বেতন পাননি। বাধ্য হয়ে গ্রামে রেখে এসেছেন পরিবার। এখন একটি মেসে উঠেছেন। সেই বাসাটিও এখন ফাঁকা বলে জানান গোলাম রব্বানী।
শুধু ঢাকা নয়, এর পার্শ্ববর্তী এলাকা সাভারের অবস্থা আরও খারাপ। বিশেষ করে যেসব বাড়িতে পোশাক শ্রমিকরা ভাড়া থাকতেন, তার অনেকগুলোই এখন ফাঁকা।
সাভারের রেডিও কলোনির অধিবাসী সরকারি চাকরিজীবী তাজ রহমান বলেন, ‘আমাদের বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট এ মাসে ফাঁকা। কোনো ভাড়াটিয়া পাইনি। ভাড়া কমিয়ে দিয়েছি, তাও পাইনি।’
সাভারের জোড়পুল এলাকার একটি ডেনিম প্রসেসিং প্ল্যান্টের কাছে ২৫টি ঘর ভাড়া দিতেন খলিল শেখ। সেখানে ঘর ভাড়া নেয়া বেশিরভাগই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। আবার কেউ কেউ চা, কেউবা সবজি বিক্রি করতেন। করোনার কারণে এখন অর্ধেক ঘরই ফাঁকা বলে জানান খলিল শেখ। বিশেষ করে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া, গোবিন্দপুর, শেখদী, দনিয়া, পলাশপুর, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল এবং ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার, হাজীনগর, বামৈল, কোনাপাড়া এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট খালি রয়েছে।
উত্তর রায়েরবাগ এলাকার বেশিরভাগ দেয়ালে দেয়ালে টু-লেট, বাসা ভাড়া হবে- এমন অসংখ্য লিফলেট সাঁটানো দেখা গেছে। এ এলাকার চারতলা বাড়ির মালিক হাসিবুর রহমান। তার বাড়ির সামনে বাড়ি ভাড়ার নোটিশ লাগানো।
তিনি বলেন, ‘আমার তিনটি ফ্ল্যাট খালি। গত কয়েক মাস ধরে দু-তিনটি ফ্ল্যাট খালি। অযথা গ্যাস বিল টানছি। এই মাস থেকে তা আরও বেড়ে গেল।’
হাসিবুর রহমান আরও জানান, তার বাড়ির এক ভাড়াটিয়া একটি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করতেন। আরেকজন কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তারা দুজনই পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন।
ডেমরার হাজীনগরের পাঁচতলা বাড়ির মালিক শামীমা বেগম। স্বামী চার বছর আগে মারা গেছেন। তিনি এখন সবকিছু দেখাশোনা করেন। বলেন, ‘আমার ২-৩টি ফ্ল্যাট খালি। আগে পুরো বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া পেতাম। গত দুমাস ধরে পাচ্ছি ৪০ হাজার টাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে সন্তানকে লেখাপড়া করাই, সংসার খরচ চলে। দুজন ভাড়াটিয়া করোনাভাইরাসের কারণে খুব বেকায়দায় পড়ে বাসা ছেড়ে দিয়েছে গত এপ্রিলে। এরপর আর বাসা ভাড়া হয়নি।’
নগরের ইসদাইর অক্টোঅফিস এলাকায় একটি চারতলা আবাসিক ভবনের মালিক আক্তারুজ্জামান। চারতলায় আটটি ফ্ল্যাট। করোনার কারণে তার ভবনের তিন ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া চলে গেছেন। এতে গত তিন মাসে তিনি ৯০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। তার বাড়ির যে পাঁচ ফ্ল্যাটে ভাড়াটে রয়েছেন, তাদের মধ্যে তিন ফ্ল্যাটের ভাড়াটে তিন মাস ধরে ভাড়া দিতে পারছেন না। তারা নগরের বিভিন্ন গার্মেন্টের কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন না পাওয়ায় তাদের এই অবস্থা। আর ওই বাড়ির যে দুই ভাড়াটে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করছেন, তাদের অবস্থাও বেশি সুবিধার নয়।
এ চিত্র শুধু আক্তারুজ্জামানের ক্ষেত্রেই নয়, বরং নগরের অনেক বাড়ির মালিক একই সমস্যার মধ্যে আছেন। কোনো কোনো ভাড়াটে খরচ কমাতে বর্তমান বাসা ছেড়ে দিয়ে কম দামের বাসা ভাড়া নিয়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার শহরের বাড়ি গুটিয়ে পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের বাড়ি।
নারায়ণগঞ্জ মহানগরের ইসদাইর এলাকার রফিকুল ইসলাম জীবন বলেন, ‘আমার বাড়ির ১৫টি ফ্ল্যাটের মধ্যে চারটি ফ্ল্যাট করোনা সংক্রমণের পর খালি হয়ে গেছে। বাকি ভাড়াটেদের মধ্যে সাতজনই ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারছেন না। তাদের মধ্যে চারজনের ভাড়া কমিয়ে দিয়েছি।’
জামতলা এলাকার আবু সাউদ মাসুদ বলেন, ‘আমার টিনশেড বাড়িতে পাঁচটি ভাড়াটে ছিল। তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু করোনার পর থেকে একটি ভাড়াটেও নেই।’
করোনা পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাড়িতেই তিন-চারটি করে ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে। ভাড়াটিয়া চেয়ে ‘টু-লেট’ লেখা বিজ্ঞাপন ঝোলানো রয়েছে অধিকাংশ বাড়িতে।