বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন শুরু

367

মিরর বাংলাদেশ : জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড। সময় বিকেল সাড়ে ৪টা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শত শিশুশিল্পী। তাদের কচি কণ্ঠে ধ্বনিত হলো জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আর এর মাধ্যমেই শুরু হলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ১০ দিনের বর্ণিল উৎসব।
বুধবার বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীর দিনটিতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উদ্বোধন হলো এই বর্ণিল উৎসবের। ১০ দিনের এই উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের থিম ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’।
জাতীয় পর্যায়ের এই উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আছেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্। ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে উৎসবের রঙে রঙিন প্যারেড গ্রাউন্ড
বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার আগেই অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে জাতির পিতার স্মৃতি ও স্মারক সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, জাতির পিতার সহচর্য যারা পেয়েছেন, যারা জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন, তারাও জীবন সায়াহ্নে রয়েছেন। তাই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে তার স্মৃতি ও স্মারক সংরক্ষণ করতে হবে, যেন তার দেশপ্রেমের মহান গাঁথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, তারা আলোকিত হতে পারে।
জাতির জনকের স্মৃতির কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, জাতির পিতার আজীবন লক্ষ্য ছিল এই দেশের মানুষের মুক্তি। তিনি মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও কেবল দেশের নিপীড়িত জনতার কথাই ভেবেছেন। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন উচ্চারণ কেবল একজন মহানায়কই করতে পারেন। দেশকে, দেশের মানুষকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেই কেবল স্বাধীনতা ও মুক্তির গান এভাবে গাওয়া যায়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সব শক্তি নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একটি সমৃদ্ধি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ তারই প্রমাণ।
রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যের শুরুতেই অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশেষ অতিথি মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্ ও ফার্স্টলেডি ফাজনা আহমেদকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, জাতির জনকের এই জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। দেশবাসী ও দেশের বাইরে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে এই মহান দিনে জানাই আন্তরিক অভিবাদন ও উষ্ণ অভিনন্দন।
অনুষ্ঠানে এর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা’র পাঠানো ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়। ভিডিওবার্তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, এসব বিশ্বনেতারা তাদের বার্তায় দুই দেশের সম্পর্ক ও উন্নয়নের কথা তুলে ধরেছেন। তাদের বার্তা এই আয়োজনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমি আশা করি, এসব উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুরে সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে। চীন, জাপান ও কানাডার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
ফার্স্ট লেডি ফাজনা আহমেদকে নিয়ে এই বিশেষ আয়োজনে উপস্থিত থাকার জন্য মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্’কে ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এসময় বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে বলেও আশাবাদ জানান তিনি।
উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ বাংলাদেশ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে সহজে নামানো যাবে না। । পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। তেজগাঁয়ের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল বাধা পেরিয়ে দেশকে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবোই, ইনশাআল্লাহ।
আজকের অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে নামানো যাবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা এই করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশবিরোধী অপশক্তি এখনও দেশে-বিদেশে সক্রিয় রয়েছে। তারা নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে এ অর্জনকে নস্যাৎ করতে চায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শুভ জন্মদিনে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সকল অপতৎপরতা প্রতিহত করে প্রিয় মাতৃভূমিকে উন্নয়ন-অগ্রগতির পথ ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সোনার বাংলা গড়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক্ষার প্রহরের আজ অবসান হতে চলেছে। আজ এমন এক সময়ে আমরা জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি, যখন বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মর্যাদাশীল উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। মাথাপিছু আয় ২ হাজার মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। দারিদ্রের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। আর্থ- সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টা এবং জনগণের ঐকান্তিক পরিশ্রমের ফসল আজকের এই প্রাপ্তি। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই তারা আমাকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন বলে।
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন করা হয়। শুরু হয় মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা, তখন কেবল অপেক্ষা ১৭ মার্চের। সেদিন বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল।
তবে এর আগেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস, ৮ মার্চ দেশেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ রাত ৮টায় দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়। এরপর মুজিববর্ষ ঘিরে সব আয়োজনই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে সব অনুষ্ঠান ঠিকমতো আয়োজন করতে না পারায় মুজিববর্ষের মেয়াদ এ বছরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এবারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা হলেও স্তিমিত থাকায় এবং দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম গতিশীল থাকায় ফের মুজিববর্ষ তথা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন করছে সরকার। বর্ণাঢ্য আয়োজনে ১৭ মার্চ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্থীর মাহেন্দ্রক্ষণ ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী চলবে এই আয়োজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।
১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে প্রতিদিন আলাদা থিমভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অডিওভিজ্যুয়াল এবং অন্যান্য বিশেষ পরিবেশনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। অনুষ্ঠানমালায় আরও যা থাকছে
দ্বিতীয় দিন ১৮ মার্চ : আয়োজনের থিম ‘মহাকালের তর্জনী’। এ অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করবেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন।
১৯ মার্চ : অনুষ্ঠান ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা’। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে উপস্থিত থাকবেন।
২০ মার্চ : ‘তারুণ্যের আলোকশিখা’। এই অনুষ্ঠানে ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল ড. ইউসেফ আল ওথাইমিন শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন।
২১ মার্চ : আয়োজন ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান’। এতে দেশিয় একাডেমিসিয়ানরা বক্তব্য দেবেন।
২২ মার্চ : আয়োজন ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’। এদিন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাÐারি উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া শুভেচ্ছা বার্তা দেবেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা।
২৩ মার্চ : ‘নারীমুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতা’। এদিন ইউনেসকোর ডিজি উপস্থিত থাকবেন।
২৪ মার্চ : ‘শান্তি-মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’। এদিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং উপস্থিত থাকবেন। শুভেচ্ছা বার্তা দেবেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস।
২৫ মার্চ : ‘গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা’। এদিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সু কুয়েন এবং তাকাশি হাওয়াকাওয়ার পুত্র ওসামু হাওয়াকাওয়া শুভেচ্ছা বার্তা দেবেন।
২৬ মার্চ : আয়োজন ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন