মিরর বাংলাদেশ : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ঐতিহ্যের একটি সংজ্ঞা রয়েছে। যা আমাদের দেশে নেই। নেই ঐতিহ্যের সঠিক সংজ্ঞাও। তাই ঐতিহ্যরক্ষার জন্য কাজ করা যেমন জরুরি তেমনি সেটির সংজ্ঞা এবংসংখ্যা নির্ধারণ করাও জরুরি। আর পুন: উন্নয়ন বাস্তবায়নেরক্ষেত্রে অবশ্যই ঐতিহ্য ধরে রেখেই পুরান ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণএলাকায় কাজ করতে হবে।
শনিবার রাজধানীরসিরডাপ মিলনায়তনে ‘পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ওপুনঃউন্নয়ন: কর্তৃপক্ষের করণীয় ও বিশেষজ্ঞ ভাবনা’ শীর্ষকসেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ঢাকায় কর্মরত সেবা খাতেরসাংবাদিকদের সংগঠন ‘ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্সঅ্যাসোসিয়েশন (ডুরা) এই সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে ডুরার সভাপতি মো. রুহুল আমিন এর সভাপতিত্বপ্রধান আলোচক হিসেবে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন রাজধানীউন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ওডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুলইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডুরার সাধারণ সম্পাদকশাহেদ শফিক।
মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ ভবনমালিক বলেনবাবার বাড়ির ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবেন। ভালো কথা, তবে আমিকী পেলাম? বর্তমানে ইতিহাসের বিবর্তনে পুরান ঢাকার অনেকঐতিহ্য হুমকির মুখে। এগুলো রক্ষায় রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা দরকার।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আটটি থানা আর ২৩টি এলাকাজুড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে পুরানঢাকা। এই এলাকার উন্নয়ন ও পরিবর্তন ছাড়া রাজধানীরপরিবর্তন সম্ভব নয়। অথচ এই জায়গাটুকুতে জনগনত্ব এতোবেশি! যেটি ভাবা যায় না। পুরান ঢাকার বড় সমস্যা হচ্ছে, পুরাতনজরাজির্ণ ভবন, ছোট আকারের কক্ষ, পর্যাপ্ত আলো বাতাসেরব্যবস্থা না থাকা এবং ঘিঞ্জি পরিবেশ। এছাড়াও পর্যাপ্ত রাস্তারঅভাব, হকারদের রাস্তা দখলে রাখাতো আছেই। পানি ব্যবস্থাপনাও ড্রেনেজ সমস্যাতো রয়েছেই।’
তিনি জানান, পুরান ঢাকা ভূমিকম্পের জন্য খুব ঝুঁকিপূণর্, কারণসরু রাস্তা এবং দূর্বল ভবন কাঠামোর কারণে উদ্ধার অভিযানেরসুযোগ নেই। এসব কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও অতিরিক্ত ঝুঁকিথাকে। এই জন্য নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে।যদিও এটি পুরান ঢাকায় সম্ভব নয়। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লটগুলোকেএকত্রিত করে ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন করা প্রয়োজন। প্রয়োজনেআলাদা বিধিমালা করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, নতুন বিধিমালায় হ্যারিটেজ রক্ষার ক্ষেত্রেও ভাবতেহবে। যারা নিজের সড়ক, উšে§াক্ত স্থান, জলাশয়, হারানোক্ষতিগ্রস্ত মালিককে বাড়তি সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। ভূমিমালিকদের প্রণোধনা বা অন্যত্র জমির ব্যবস্থা করে পুন: উন্নয়নকরা যেতে পারে।’
গবেশণাপত্রে নতুন ড্যাপে পুরান ঢাকার জন্য বিশেষ কিছুসুপারিশের কথা উল্লেখ্য করা হয়, যারমধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিকস্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রে পরিণতকরা, বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘীরে সাংস্কৃতি বলয় গড়ে তোলা, ভূমির পুন: উন্নয়ন করে মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করা, রাসায়নিক গুদামপর্যায়ক্রমে সরিয়ে সাংস্কৃতিক গ“রুত্ব তুলে ধরে জনপরিসর গড়োতোলা ইত্যাদি।’
গবেষণাপত্রে পুরান ঢাকার নগর পুন: উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়- পুন: উন্নয়ন করা হলে যাতেএলাকার সাধারণ মানুষ সুবিধাভোগী হয়, অবশ্যই এলাকাবাসিরসঙ্গে মতোবিনময় সভা করা, রাজউক কর্তৃক আরবানরিডেবেলপমেন্ট বিষয়ক করা খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করা, প্রকল্পভুক্ত এলাকাসমূহে ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসংরক্ষণ করে স্থানীয় বৈশিষ্ট বজায় রেখে নগর পুন: উন্নয়ননিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট সেবাখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতেহবে, সড়ক নির্মাণ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে হবে, কয়েকটি এলাকায় ৬০ ফিট প্রসস্থ রাস্তা করা, উন্নয়ন প্রকল্পচলাকালে প্রকল্পভুক্ত জনগণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আবাসনসুবিধা প্রদানকল্পে প্রকল্প এলাকার সন্নিকটে সুবিধাজনক স্থানেআবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
গবেষণাপত্রে কর্তৃপক্ষের কিছু দায়িত্বের মধ্যে সরকার/কর্তৃপক্ষ/ দাতা সংস্থা কর্তৃক প্রাথমিক অর্থায়ন, প্রধান সড়ক, স্বাস্থ্যসেবা, স্কুলউপযোগী করে তোলা এবং স্থানীয় সরকারের অধীনে কমিউনিটিসেন্টার, খেলার মাঠ, পার্ক, এসটি, পথচারী/সাইকেল লেনেরউন্নয়ন করার বিষয় উল্লেখ করা হয়।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি ছোট বাড়ি নিয়ে একটি ব্লকহতে পারে। নিজেরা সম্মত হলে তিনটি পদ্ধতিতে এটি করা যেতেপারে। এরমধ্যে রাজউকের সহযোগীতায় ভূমি মালিক সমিতিরনিজস্ব উদ্যোগের মাধ্যমে, রাজউকের সহযোগীতায় ভূমি মালিকসমিতির সাথে ডেভেলপার কোম্পানির চুক্তির মাধ্যমে এবং ভূমিমালিক সমিতির সাথে রাজউকের চুক্তির মাধ্যমে এটি হতে পারে।তবে এই পুন: উন্নয়নে কয়েকটি চ্যালেঞ্জেও রয়েছে।’
আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নগর ও অঞ্চলপরিকল্পনা বিভাগ’র সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউটঅব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি, আকতার মাহমুদ বলেন, ‘ঐতিহ্যের কোন সঠিক সজ্ঞা নেই! এটি খুব হতাশার। এতো এতোউদ্যোগ দেখে ভালো লাগছে। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ এবংনগরপরিকল্পনাবিদদের মধ্যে মতের অনেকটা মিল দেখেওআশান্বিত হচ্ছি। একই সঙ্গে বলতে হয়, শুধু পরিকল্পনা করলেইহবে না। বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা সরকারেরসদিচ্ছা। এছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের আরেকটিঅন্তরায়। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোন সমš§য়নেই। তাই সরকার যদি চায় যেকোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব।আমরা দেখি এতো এতো পরিকল্পনার মধ্যে মাত্র ২৩% বাস্তবায়নহচ্ছে।’
সেমিনারে ঐতিহ্যের সংজ্ঞা আগে নির্ধারণ করতে হবে বলে মতদেন আরবান স্টাডি গ্র“পের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম। তিনিবলেন, একদিকে ঐতিহ্যের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে জরাজীর্ণভবনের কথা বলা হচ্ছে। জরাজীর্ণ ভবনের কথা বলে করোনারসময় অনেক ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। ২০০৯ সালের সরকারিতালিকা অনুযায়ী পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী ভবন ৯৪টি। আবার২০১৭ সালের তালিকা অনুযায়ী ৭৫টি, কিন্তু ভবন রয়েছে একহাজার ৮৩১টি। তাই সেই তালিকা ঠিক করা উচিত।
ভবন না ভেঙেও সংরক্ষণ করা যায় জানিয়ে তাইমুর ইসলামবলেন, সমন্বিতভাবে কাজ না করলে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করাযাবে না। রাজউক তার মতো ভাবছে, সিটি করপোরেশন তার মতোভাবছে এবং প্রতœতত্ত্ব বিভাগ তার মতো ভাবছে। প্যারিস, লন্ডনেরমতো অনেক শহর আছে যেখানে আধুনিকতার সব আছে পুরাতনকাঠামোকে রেখে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলেরেজা সুমন, ‘পুরান ঢাকায় প্রধান সমস্যা যানজট। তাই এইসমস্যার সমাধানে উদ্যোগ জরুরি। এছাড়া আমরা দেখিকর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনারপাশে আট দশ তলা ভবন কিভাবে হয়? তারা কিভাবে অনুমোদননিচ্ছেন? এসব বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে।’
ঐতিহ্য বিশেষজ্ঞ স্থপতি মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শুধুভবন নয়, পুরান ঢাকার সংকীর্ণ রাস্তাও তার ঐতিহ্য। সবসময়রাস্তা ভেঙে বড় করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। সেখানে ফায়ারসার্ভিস বা অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে পারবে না, তা না। সেসব গাড়িপ্রবেশের জন্য কাস্টমাইজড যানবাহনের বিষয়ও ভাবার প্রয়োজনআছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখমুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ‘নগর উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোরসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ নেই। এমন হলে সঠিক পরিকল্পনাকিভাবে আসবে। এক দুইজন পরিকল্পনাবিদ দিয়ে এটি সম্ভব না।সব সেবা প্রতিষ্ঠানের উচিত পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে কাজ করা।’
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগেরঅ্যালামনাই আয়েশা সাঈদ বলেন, ‘পুরান ঢাকাকে পরিবর্তনকরতে হলে শুরুতেই কমিউনিটিকে এক করতে হবে। সংশ্লিষ্টপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি বিষয় মনেরাখতে হবে, আমরা যতই বলি সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর করেফেলবো সেটি সম্ভব না। তবে আমাদের যা আছে তা দিয়েনিজেদের মতো করে অবশ্যই পুন: উন্নয়ন সম্ভব।’
সভাপতির বক্তব্যে ডুরা সভাপতি মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘ঢাকাইউটিলিটি রিপোর্র্টার্স অ্যাসোসিয়েশন পেশাগত সাংবাদিকতায়মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সেবাখাতের সংবাদের ক্ষেত্রে যাতেসঠিক তথ্য মানুষ জানতে পারে সে জন্য বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠানআয়োজন করা হয়। আজকে পুরান ঢাকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েঅনুষ্ঠানে উপস্থিত বিজ্ঞ আলোচকদের মূল্যায়ন এবং পরামর্শসংস্লিষ্ট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান মূল্যায়ন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
বক্তারা বলেন, ২০১৮ সালের রিটের রায় অনুযায়ী পুরান ঢাকায়এমন অনেক স্থাপনা রয়েছে যেগুলো ভাঙা যাবে না। কিন্তু এই চারবছরেও অনেক ভবন ভাঙা হয়েছে। পুরান ঢাকাকে এড়িয়ে কোনোউন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের এই ঐতিহ্যগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।একইসঙ্গে উন্নয়নের প্ল্যানটাও ইমপ্লিমেন্ট হওয়া প্রয়োজন। তাই এইঐতিহ্য ধরে রেখে সমন্বিতভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।অনুষ্ঠানে সভাপতির স্বাগত বক্তব্যের পর সংক্ষিপ্ত আলোচনাকরেন ডুরার সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম শামীম, অর্থসম্পাদক শাহজাহান মোল্লা সাজু, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক বারেক হোসেন। এসময় অনুষ্ঠানে উপস্থিতছিলেন ডুরার সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনরুবেল, নির্বাহী সদস্য রফিকুল ইসলাম রনি, সানাউল হক সানি, মুসা আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়শ্রী ভাদুড়ী, সাংগঠনিকসম্পাদক নিলয় মামুন, প্রচার ও দফতর সম্পাদক জহিরুলইসলাম।