চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ঘুষ কেলেংকারিতে বরখাস্ত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা

161

মিরর বাংলাদেশ : চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ যেন এক ঘুষের বাজার। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এখানে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। ঘুষ ছাড়া এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যায়না ফাইল। সম্প্রতি ঘুষের লেনদেনের কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হলেও নড়ক নড়েনি এখানকার উধ্বতন কতৃপক্ষের। যে কারণে অসাধু, ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সব অনিয়মের বিরুদ্ধে এনবিআর চেয়ারম্যানের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না অসাধু এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল এই কাস্টম হাউজের আরেক সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা শেখ আবদুল হাদির প্রকাশ্যে অফিসের চেয়ারে বসে ঘুষ নেয়ার ভিডিও সামনে আসে। যা নতুন করে ব্যাপক চঞ্চল্য তৈরি করেছে কাস্টম হাউজের অভ্যন্তরে। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।

এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতারা বলছেন, এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে প্রতিনিয়ত এ ধরনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম সর্বত্র বেড়েছে। আস্থা হারাচ্ছে সেবাগ্রহীতারা, রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

এই প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাবলিলভাবে নিজ চেয়ারে বসে আছেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) শেখ আবদুল হাদি। তার টেবিলের সামনে সেবাগ্রহীতা ও অনেক দর্শনার্থীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। এ সময় তার পাশে এসে একজন সেবাগ্রহীতা (সম্ভবত সিএন্ডএফ এজেন্ট) তার সঙ্গে ফিসফিস করে কি যেন বলছেন। কথার ফাঁকে খুব সাবধানতার সঙ্গে তার হাতের মধ্যে ঘুষের টাকা গুজে দিচ্ছেন। ভিডিওতে টাকার অংক বোঝা না গেলেও স্পষ্টত কয়েকটি এক হাজার টাকার নোট হবে বলে মনে হচ্ছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সেকশন ৯(এ) এতে কর্মরত এই কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন সেবাগ্রহীতা এই কর্মকর্তার হয়রানির কথা জানিয়ে বলেন, টাকা ছাড়া উনি কিছুই বুঝতে চান না। টাকা না দিলে কোনো না কোনোভাবে ফাইল আটকিয়ে হয়রানি করেন।

এ বিষয়ে জানতে ঘুষ নেয়া কর্মকর্তা আবদুল হাদির দুটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলে প্রথমে সাড়া না দিলেও এক পর্যায়ে তিনি এই প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, এই ভিডিও তিনি কিভাবে পেয়েছেন, কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে, কারা এই এই ভিডিও করেছে, এসব বিষয় জানতে চান। পাশাপাশি তাকে ঘুষ দেয়া ওই সেবাগ্রহীতাকে খুঁজছেন বলেও জানান। তবে ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করেননি তিনি।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ এবং হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি, বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাদের বরখাস্ত করা হয়। এছাড়াও, কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জাল কাগজপত্র তৈরি করে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে।
জানা যায়, গত ২৭ জুলাই সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তাসহ দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের হালিশহর সার্কেলের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুল আলীম ও সিপাই মো. শাহরিয়ার রহমান।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতিবাজ চক্রের সদস্যরা (অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী) আমদানিকারকদের নানা কৌশলে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। পণ্যের শুল্কহার ঠিক রেখে দ্রুত ছাড়পত্র নিতে আমদানিকারক কিংবা তার প্রতিনিধিকে সশরীরে যেতে হয় কয়েকটি পয়েন্টে। এসব পয়েন্টে যারা থাকেন তাদের সন্তুষ্ট করতেই দিতে হয় ধাপে ধাপে ঘুষ। তবে ঘুষকে এরা কেউই ঘুষ বলেন না, বলেন ‘স্পিডমানি’। যিনি যত বেশি স্পিডমানি দেন, তত বেশি দ্রুতগতিতে হাঁটে তার ফাইল। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে পণ্য শনাক্তকরণ (এইচএস) কোডের ফাঁদে ফেলে আইনি মারপ্যাঁচে আটকে রাখা হয় ফাইল। এতেই আমদানিকারকরা ক্ষতির সন্মুখীন হন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সিএন্ডএফ প্রতিনিধি এমন তথ্য জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এই শুল্ক স্টেশনে আমদানিকারকদের গলা কাটতে তারা চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায়ের নিত্যনতুন কৌশল বের করেন। শতভাগ কায়িক পরীক্ষা হওয়ার পরও পণ্য পুনঃপরীক্ষার নামে চলছে হয়রানি। এসব বিষয় নিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য তুলে ধরা হলে আমদানিকারকের প্রতিনিধিদের রীতিমতো অপমান-অপদস্ত এমনকী আইনের নানা ফাঁক-ফোকর বের করে কখনো তাদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়।

পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় এখনো ধাপে ধাপে হয়রানির শিকার ব্যবসায়ীরা হয়রানি থেকে বাঁচতে স্বনামে বক্তব্য দিতেও অস্বীকৃতি জানান। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ পেলে পণ্য খালাসে তাদের হয়রানি আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। তারা জানান, ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না কাস্টমস হাউসে। সহকারী কমিশনার থেকে উপরের লেভেলে ঘুষের পরিমাণ কম থাকলেও নিচের লেভেলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।