শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে না : প্রধানমন্ত্রী

174

* ভারত সফর নিয়ে গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলন

*  এক দেশের ভেতর অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে কোনো ক্ষতি নেই
*  জীবনেও আমার নোবেল প্রাইজের জন্য কোনো আকাঙ্খা নেই
*  তিস্তার প্রজেক্টের জন্য চীন ও ভারত প্রস্তাব দিয়েছে
*  ভারতে চিকিৎসার জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে
*  মানুষকে ভয়, সাপ-জীবজন্তুকে নয়

মিরর বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি। এক দেশের ভেতর অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে কোনো ক্ষতি নেই। শেখ হাসিনা এই দেশকে বিক্রি করে না । বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেলপথ ব্যবহারের সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটা নিয়ে কেন সমালোচনা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। ইউরোপে তো এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের কোনো বর্ডার নেই, তারা কি বিক্রি হয়ে গেছে? এতে বরং তাদের যোগাযোগ সুবিধা বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে।

মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে গণভবনে সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নোবেল প্রাইজের জন্য না কি আমি ড. ইউনূসকে হয়রানি করছি। আমার সঙ্গে আসলে কারো কোনো দ্বন্দ্ব নেই। জীবনেও আমার নোবেল প্রাইজের জন্য কোনো আকাঙ্খা নেই। নোবেল প্রাইজ পেতে লবিস্ট রাখার মতো অত টাকা-পয়সাও নেই। আর আমি কখনো চাইনি।
ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করার পর অনেক বিদেশি, অনেক নোবেল বিজয়ী আমাকে নিয়ে লিখেছে। কই আমি তো তদবির করতে যাইনি। ওগুলো আমার মাথার মধ্যেও নেই। যিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলেন, ব্যাংকের একটা এমডি… সে যখন একটা নোবেল প্রাইজ পায়, সেজন্য আমি কনটেস্ট করতে যাবো কেন?
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি আমি করেছি। পৃথিবীতে যত শান্তিচুক্তি হয়েছে, কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পন করেছে? এক হাজার ৮০০ জন অস্ত্রধারী আমার কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে। আমি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির কারণে আজকে সেখানে উন্নয়ন হয়েছে। চুক্তির আগে সেখানে কী অবস্থা ছিল? সেখানে কী আমরা কেউ যেতে পারতাম? ৬৪ হাজার শরণার্থী ছিল ভারতে। আমি তাদের ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, কেউ যদি এখন আমার নামে নোবেলের জন্য প্রস্তাব দেয়… আমরা তো যাইনি তাদের কাছে। আমার আসলে এসব পুরস্কারের দরকার নেই। এখানে আলাদা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, এখানে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আর বলে দিলো এটা নিয়ে আমার না কি জেলাসি!
সরকারপ্রধান বলেন, তিনি (ড. ইউনূস) তো রাজনৈতিক দল করতে চাইছিল, সেটিও লেখালেখি হয়েছে। ২০০৭ সালে দল করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হলেন কেন? গ্রামের মানুষের জন্য যিনি এত কিছু দিয়ে থাকে, তিনি দল করতে পারলেন না কেন? তার দলে তো সেই মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। তারা সাড়া দেয়নি। কারণ তারা সুদের চাপে মৃতপ্রায় ছিল। সে দায় কী আমার? আর আমি তো তখন জেলে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমি বিদেশে… আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছিল। আমি তো দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাকে বলা হলো, ফিরতে দেওয়া হবে না। আমি তো ফিরেছি। আমার সঙ্গে তার কীসের তুলনা? যায় না।
তিনি বলেন, আমি তো কখনো কিছু বলিনি। একটা প্রশ্ন আমার, এই যে বিদেশে বিদেশে বিনিয়োগ, এটা কীভাবে হলো? টাকাটা কোত্থেকে আসলো, কাদের টাকা? সেই জবাবটা দিক। এটা সংবিধিবদ্ধ চাকরিতে থাকা অবস্থায় বিদেশে বিনিয়োগ, আইন কী বলে? আমরাই তো সবাই মিলে তাকে তুলেছি, এটা ঠিক। এখন না কি সব দোষ আমার। কারণ সব থেকে বেশি টাকা আমি দিলাম তার গ্রামীণ ব্যাংকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার গ্রামীণ ব্যাংক দাঁড় করাতে টাকা দেওয়া, ১৯৯৭-৯৮ সালে বন্যা… গ্রামীণ ব্যাংক যায় যায় অবস্থা। ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছি। সব থেকে বেশি যে করে, তার মূল্যায়ন এমন! আবার জেলাসি… জেলাসি করার কী আছে? সে আসুক না, মাঠে আসুক! চলুক আমার সঙ্গে। আসুক, কথা বলব। সব থেকে বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে আমার কাছ থেকেই।
শেখ হাসিনা বলেন, উনার পয়সা আছে, উনি লেখাচ্ছেন। উনি যদি এতই জনপ্রিয় হন, তাহলে বিজ্ঞাপন কেন? তার জন্য তো সারা বিশ্ব ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। একটা মামলা চলছে। সেটি নিয়ে তো আমি কথা বলতে যাই না।
বাংলাদেশকে তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানি দেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক বিরোধিতা করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। বিষয়টি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠিও দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কথা হয়েছে এবং মমতার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ বিষয়ে ঢাকা নাক গলাবে না।
তিস্তা প্রসঙ্গে মমতার অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়েই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে পানি দিতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে মমতার হুঁশিয়ারি, কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই ভারতজুড়ে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বলে দেশে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তারা বলুক বিক্রিটা কিসের মাপে হচ্ছে? মাপটা কিসের মাধ্যমে হচ্ছে? বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। সারাবিশ্বে একটিমাত্র মিত্র শক্তি ভারত, যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীন করে দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কোন দেশ যুদ্ধে সহযোগিতা করতে এলে তারা সেখানেই থেকে যায়। বিজয়ী হওয়ার পরও তারা দেশ ছাড়ে না। এরকম অসংখ্য নজির আমরা দেখেছি। অথচ ভারত আমাদের মিত্র হিসেবে যুদ্ধ করেছে এবং জাতির পিতার আহ্বানে আবার তারা ফিরেও গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাহলে বাংলাদেশ কীভাবে বিক্রি হয়? আমি বলবো যারাই বলছে দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তারাই বরং দেশকে বিক্রি করতে চেয়েছে। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রেখেছি। এখন যারা দেশ বিক্রির কথা বলে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালালি করেছে।
তিনি আরও বলেন, রেলপথ ব্যবহারের ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হচ্ছে। ওইসব এলাকার মানুষের জন্য যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। ইউরোপে তো বর্ডারই নেই, তারা কি তাহলে বিক্রি হচ্ছে? প্রত্যেকটা দেশই তো স্বাধীন দেশ, তারা তো বিক্রি হয়নি। তাহলে সাউথ এশিয়ায় কেন এটা বাধা হয়ে থাকবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে। সে ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর ‘স্মার্ট-বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি। এ সফর ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আমি মনে করি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এ সফর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ জুন দিল্লি পালাম বিমানবন্দরে আমাকে বর্ণাঢ্য অভ্যর্থনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। ওই দিন সন্ধ্যায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও, ভারতের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সম্ভাবনা ও পন্থা নিয়ে আলোচনা করে। এসময় আমার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও আলোচনায় অংশ নেয়।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বৈঠকে আমরা অন্যান্য পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং সীমান্তে হতাহতের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পানি বণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করি। আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তার সুবিধাজনক সময়ে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে দ্বিপাক্ষিক সফরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস, চট্টগ্রাম ও কলকাতার মধ্যে নতুন বাস পরিষেবা চালু, গেদে-দর্শনা এবং হলদিবাড়ি-চিলাহাটির মধ্যে দলগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালু হলে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সফরে দুই দেশের মধ্যে ৫টি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয় এবং ৩টি নবায়িত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত বিনিময় হয়। এছাড়া দুটি রূপকল্প ঘোষণা স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয়। বৈঠকে ভবিষ্যতের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ১৩টি যৌথ কার্যক্রমের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, তাদের জন্য আমরা ভিসা সহজ করে দিয়েছি। এখন সহজেই সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসা যাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, তাদের জন্য ভিসা সহজ হয়ে যাবে। আমরা তো কেবল উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন আমরা যত বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারি, যত বেশি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের আদান-প্রদান হবে, ততই বাংলাদেশ লাভবান হবে।
তিস্তা প্রজেক্ট ভারত ও চীন করতে চায় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তার প্রজেক্ট যদি আমরা করি, তার জন্য চীন ও ভারত প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্যই আমরা বিবেচনা করব, কোন প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমাদের দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে, সেটাই গ্রহণ করব। ভারত বলেছে তারা করতে চায়, তারা টেকনিক্যাল গ্রুপ পাঠাবে, অবশ্যই তারা আসবে। চীনও একটা ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে, ভারতও একটা করবে। আমাদের কাছে যাদেরটা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং লাভজনক, আমরা সেটাই করব।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীবজন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সাপ বরং মানুষকে ভয় পায়। ভয় বা আতঙ্ক থেকেই মানুষকে কামড় দিতে আসে। তাই সাপকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় করলে মানুষকেই করতে হয়, জীবজন্তু বা সাপকে নয়।