সার আমদানিতে চুক্তির আড়ালে ভয়ংকর সিন্ডিকেটের কারসাজি !

13

মিরর বাংলাদেশ : বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নামেই চলছে অনিয়মের মহোৎসব। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জি-টু-জি (Government to Government) চুক্তির মাধ্যমে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকেই সার আমদানি করার কথা। কিন্তু সেই নীতিমালা আজ কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে, জি-টু-জির নামে বিদেশি বেসরকারি ট্রেডিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে চলছে শত শত কোটি টাকার পাচার ও নিম্নমানের সার আমদানির ভয়ংকর খেলা।
সূত্র জানায়, চীনের বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে বিএডিসি চুক্তিবদ্ধ হয়, যা জিটুজি নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বানিয়ার ঠিকানা—গ্লু ডিস্ট্রিক্ট, ফুজিয়া, চায়না। এই কোম্পানিকে রপ্তানিকারক হিসেবে দেখিয়ে প্রথম বছরই চীনের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান—ইউয়া ও শ্যাং ফ্যাং থেকে নিম্নমানের সার আমদানি করা হয়।
এলসি (Letter of Credit) খোলা হয় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এমন চুক্তি শুধুমাত্র সরকারি পর্যায়ের উৎপাদনকারীদের সঙ্গেই করা যায়। ফলে স্পষ্ট হয়—রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আড়ালে চলছে ব্যক্তিগত ব্যবসা, আর জিটুজির নামে আসলে হচ্ছে জালিয়াতি ও অর্থপাচার।চায়নার বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে “রাষ্ট্রীয় চুক্তি”
বিএডিসি চীনের বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেডকে শুধু অনুমতি দেয়নি, বরং তাদের হাতে তুলে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা—চায়নার যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সার আমদানির ও যে কোনো বন্দর ব্যবহারের অধিকার। ফলাফল? সহজ হয়ে গেছে নিম্নমানের ও ভেজাল সার আমদানির পথ।
তদন্তে জানা গেছে, আমদানীকৃত ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (DAP) সারে এলসি অনুযায়ী থাকা উচিত ১৮% নাইট্রোজেন ও ৪৬% ফসফেট—মোট ৬৪%। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৭% কার্যকর উপাদান। অর্থাৎ, প্রতিটন সারে প্রায় ৭% মান কম, যার অর্থমূল্য প্রতিটনে ১১০ ডলার কম। অথচ বিল তোলা হয়েছে ৮৯০–৮৯৫ মার্কিন ডলার প্রতি টন হারে।
চীনের স্থানীয় কোম্পানি বানিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড প্রতি ৪০ হাজার মেট্রিক টন সারের জাহাজে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন নিম্নমানের সার রাতের অন্ধকারে মিশিয়ে দেয়। একেকটি জাহাজে এভাবে পাচার হয় প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি।
এই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছর থেকে—যা এখন প্রান্তিক কৃষকের ১৪ কোটি জীবনের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।নাটকীয়তা ঢেকে রাখছে একটি অখ্যাত কোম্পানি :
এই ভয়ংকর প্রতারণার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব এক ইন্সপেকশন কোম্পানি—‘কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেড’। রাজধানীর বাড্ডায় ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারে অবস্থিত এই কোম্পানির নামও এর আগে কেউ শোনেনি।
এলসির ক্লজ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইন্সপেকশন কোম্পানি—যেমন SGS (আমেরিকা) বা ইন্সপেক্টরেট (ইউকে) দ্বারা সারের গুণগত মান যাচাই করার কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সোনালী ব্যাংকের ২৫০৭৩১ নম্বর এলসি (তারিখ: ৩১ জুলাই)-তে ইন্সপেকশন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই অখ্যাত, নিম্নমানের বাংলাদেশি কোম্পানিকে।
তারা সার পরীক্ষার নামে ভেজাল সারে সনদ দিয়েছে, আর সেই সনদই হয়েছে বিদেশে বিল উত্তোলনের বৈধ কাগজ।অর্থপাচার ও প্রভাবশালী যোগসাজশ:
কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কোং (বিডি) লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ উল্লাহ, যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে গড়ে তুলেছেন গভীর সম্পর্ক। তাঁর সহযোগী মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মো. সাব্বির হোসেন, যিনি নিজেকে দাবি করেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের জামাতা।
সাব্বির হোসেনই মালয়েশিয়া থেকে বিএডিসির “এজেন্ট” হিসেবে সার কেনাবেচার এই সমগ্র সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—যেখানে সাধারণত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইন্সপেকশন ফি প্রদান করে, সেখানে এই কোম্পানির বিল পরিশোধ করছে বিএডিসি নিজেই!
অর্থাৎ, সরকারি অর্থেই তৈরি করা হচ্ছে সরকারি অর্থপাচারের সেতুবন্ধন।বিদেশেও চাঞ্চল্য
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ইফা কনফারেন্সে (IFA Conference) এই চক্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সার উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা সোজাসুজি বলেন—বাংলাদেশের নামে চলছে ‘জি-টু-জি কারচুপির আন্তর্জাতিক নজির।’
বিশ্বের নজর এখন এই সিন্ডিকেটের দিকে।
দেশে তারা পাচার করছে কোটি কোটি ডলার, আর বিদেশে—বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হারাচ্ছে দিন দিন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে এলসি অডিট করে। তবু কিভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে—এ প্রশ্নে জনমনে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। তাহলে কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এই সিন্ডিকেটের ছায়ায়?
নাকি রাষ্ট্রীয় নীরবতা এখন এই দুর্নীতির নীরব অনুমোদন? প্রান্তিক কৃষকের ঘামে ভেজা টাকায় কেনা সেই সার, আজ ভেজাল আর দুর্নীতির আগুনে পুড়ছে।
আর রাষ্ট্র—দেখছে নিশ্চুপ হয়ে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)-এর চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন খান অভিযোগের বিষয়ে বলেন, “বিষয়গুলো আমি অবগত হয়েছি। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।