সীমান্ত পার হয়ে আসছে গরু

1029

মিরর বাংলাদেশ : আসছে কোরবানির ঈদকে ঘিরে আবারো সক্রিয় ভারত-বাংলাদেশের গরু চোরাইকারবারিরা। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত পার হয়ে চোরাই পথে বানের পানির মতো ঢুকছে ভারতীয় গরু। এই অঞ্চলের হাটবাজারগুলো এখন ভারতীয় গরুর ভিড়ে ঠাসা। ফলে দেশীয় গরুর দাম নেই। এই অঞ্চলের প্রায় চার লাখ খামারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। চিন্তা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হবে কিভাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্তে গরু আসা প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়া হলেও কারবারিরা থামছে না।

প্রাণিসম্পদ বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় এবার ক্ষুদ্র মাঝারি ও বৃহৎ খামারি মিলে প্রায় চার লাখ খামারির কাছে এই মুহূর্তে মজুদ আছে প্রায় ১২ লাখ গরু। এবার এই অঞ্চলের কোরবানির গরুর চাহিদা ৮ লাখের কিছুটা বেশি। এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে এই চাহিদার ৩০ ভাগই পূরণ না হওয়ার শঙ্কা। বাকি গরুগুলো উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকা, চট্টগাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু তাতেও পথে পথে বিড়ম্বনা। তার ওপর ভারত থেকে আসছে গরু। এক দিকে করোনায় মানুষের হাতে টাকা নেই, অন্য দিকে ভারতীয় গরু। হাটে বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। কঠিন পরিস্থিতিতে আছে গরু খামারি

সরেজমিন উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি হাট, লালবাগসহ বিভিন্ন হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাটে ভারতীয় গরুর আধিক্য। মোটামুটি হাটে ওঠা গরুর ৪০ ভাগই থাকছে ভারতীয় গরুর দখলে। এসব গরু অনেক লম্বা ও উঁচু। বেশির ভাগই সাদা রঙের। দামও কম। গোশত বেশি। সে কারণে ক্রেতারা কমদামে বেশি গোশতের আশায় এসব গরুর দিকেই ঝুঁকছেন। ফলে দেশীয় খামারিদের গরু তেমন একটা বেচাকেনা হচ্ছে না। অন্য দিকে দেশের অন্য এলাকাতে গরু বিক্রির জন্যও নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছেন না খামারিরা। যারাই চট্টগাম, ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় যাচ্ছেন তারাই পড়ছেন হয়রানি ও চাঁদাবাজির মুখে। এই অবস্থায় খামারিরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। বেতনভাতাও বকেয়া পড়েছে কর্মচারীদের।

রংপুরের বৃহৎ গো খামারি ক্যাপ্টেন ডেইরির চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, গরুর দাম নেই। তার ওপর বাজার সয়লাব হয়ে গেছে ভারতীয় গরুতে। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। যে গরুর দাম দেড় লাখ টাকা হওয়ার কথা। সে গরুর দাম ৭০ হাজার টাকাও বলছে না। এই অবস্থায় আমরা প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খামার গড়ে তুলেছি। ব্যাংকের টাকাও পরিশোধ করতে পারছি না। কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছি না। ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করা না হলে আমার মতো অসংখ্য খামারি পথে বসবে। বন্ধ হয়ে যাবে এই শিল্প।

আরেক বৃহৎ গো খামারি পুষ্পিতা ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী শাহ মোহাম্মদ আশরাফ উদ দৌলা আরজু জানান, আমি তিন কোটি টাকা নিয়ে খামার গড়ে তুলেছি। প্রায় ১৪০টি গরু মোটাতাজ করেছি কোরবানি উপলক্ষে। কিন্তু এখন মহাঝুঁকিতে আছি। কারণ হাটে নিয়ে যাচ্ছি। দামে মিলছে না। গরুপ্রতি লগ্নির ৪০ ভাগও দাম বলছে না গ্রাহকরা। বিক্রি না হওয়ায় আবার সেই গরুগুলো খামারে আনতেও ভয় হচ্ছে। কারণ লাম্পিসহ নানা রোগ এখন গরুর। গরু বিক্রি করতে না পারলে আমাকে খামার বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের অন্য অঞ্চলে গরু নিয়ে যেতেও সমস্যা। পথে পথে গরুর গাড়ি আটকানো এবং চাঁদাবাজি। দামই নেই। তাহলে এসব সমস্যার সমাধান করি কিভাবে।

রংপুরের আরেক খামারি গোলাম ইব্রাহিম জানান, করোনার কারণে ঈদুল ফিতরেও কর্মচারীদের বোনাস দিতে পারি নাই। কোনোমতে বেতন দিয়েছি। তার পরেও প্রায় দুই মাসের বেতন বাকি আছে ৩৫ জন কর্মচারীর। এখন তো গরু বিক্রি হচ্ছে না। কর্মচারীদের বেতন বোনাস দিবো কিভাবে। এভাবে চলতে থাকলে খামার বন্ধ হয়ে যাবে আমার। শুনেছি সরকার নাকি প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই প্রণোদনাটি কী সেটাই জানতে পারলাম না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোরবানি এলেই গরু বেচাকেনা নিয়ে সক্রীয় হয়ে উঠে এই অঞ্চলে দ্বিদেশীয় চোরাকারবারিরা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন এদেশীয় মুনফাখোর দালাল ও ফড়িয়াগোষ্ঠী। সীমান্ত সূত্র জানায়, সঙ্ঘবদ্ধ ভারতীয় সিন্ডিকেটটি এই অঞ্চলের হাটবাজারে আস্তানা গেড়ে বসেছে প্রায় দেড় মাস আগে থেকেই। শুরু হয়েছে ভারতীয় গরুর আনার কার্যক্রম। সূত্রমতে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, নাগেশ্বরী, বড়াইবাড়ি, লালমনিরহাটের মোগলহাট, পাটগ্রাম, বড়খাতা, নীলফামারীর ডোমার, চিলাহাটি, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের রুবিয়া, দিনাজপুরের হাকিমপুর, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হিলি, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাটসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আনা হচ্ছে ভারতীয় গরু।

এমন পরিস্থিতিতে বিভাগীয় কমিশনার, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভারতীয় গরু যাতে আসতে না পারে এবং দেশের অভ্যন্তরে যেন কোনোভাবেই চাঁদাবাজি না হয় সেজন্য মাস খানেক আগেই চিঠি দিয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের উপপরিচালক ডা: হাবিবুল হক জানান, ভারতীয় গরু যাতে না ঢুকতে পারে এবং দেশের ভেতরে গরু পরিবহনে যেন কোনো ধরনের ঝামেলায় না পড়েন খামারিরা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনার, বিজিবি, পুলিশসহ সব সেক্টরে আমরা গত মাসের ১৮ তারিখে চিঠি দিয়েছি তারা কাজ করছেন।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম জানান, দেশীয় গরুর খামারিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য বিভাগের বিজিবি রিজিয়নসহ প্রতিটি ডিসিকে চিঠি দিয়ে সীমান্তে গরু চোরাকারবার বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। ডিসিগণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী জনপ্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে মসজিদের মাইকে মাইকে এলার্মিং দিচ্ছে যাতে কেউ গরুর চোরাইকারবারিতে না জড়ায়। এ ছাড়াও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে সীমান্তে।

বিজিবির রংপুর রিজিয়ন সূত্র জানায়, গত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে কোরবানি উপলক্ষে কোনো গরু যেন ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (ডিআইজি) মোহাম্মদ আবদুল আলীম মাহমুদ জানান, এই অঞ্চল থেকে গরুর অন্য অঞ্চলে আনা নেয়ার সময় পথে পথে যেন কোনো ধরনের হয়রানির মুখে না পড়েন খামারিরা। কোথাও যেন কোনো চাঁদাবাজি না হয় সেজন্য পোশাকী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর আছেন। তার পরও কোনো সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি কিংবা গরু পরিবহনে নিযুক্ত পরিবহন ও ব্যক্তিকে হয়রানি করা হয়, তাহলে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক শাস্তির আওতায় আনা হবে।

রংপুর হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ জাহিদুল ইসলাম জানান, হাইওয়েতে কেউ যদি গরু ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের হয়রানি করে সাথে সাথে তাদের আইনের মুখোমুখি করা হবে। সেজন্য আমি নিজেই হাইওয়ে মনিটরিং করছি